চৌদ্দশ থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত প্রায় ৬২৩ বছর ধরে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে পৃথিবীর একটা বড় অংশ শাসন করত তুরস্কভিত্তিক অটোমান সম্রাটরা। আর ১০০ বছর পর বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চল বা পাহাড়ি এলাকা আর দক্ষিণের সুন্দরবন বাদে পুরো দেশই বলা যায় আজ ‘অটো’ নামক ব্যাটারিচালিত বিচিত্র রং-ঢঙের গাড়ির নিয়ন্ত্রণে। এসব অঞ্চলের রাস্তাঘাট এখন অটোচালক নামক ‘অটোম্যান’দের দখলে। তবে তুরস্কভিত্তিক অটোমানদের সাম্রাজ্যে একজনই ছিলেন সম্রাট, যাকে সবাই সুলতান বলে সমীহ করত এবং অটোমান সম্রাট নামে চিনত ও মানত। কিন্তু বাংলার রাস্তাঘাট, চৌরাস্তা, জংশন, মোড়, শহর-বন্দর, অলিগলি, হাটবাজার থেকে শুরু করে রাজপথসহ যাবতীয় সবকিছু শাসন, শোষণ ও তোষণ করেন ‘অটোম্যান’ নামক অটোচালকরা। তাই বলা চলে, বাংলা নামক ভূখণ্ড এখন পরিণত হয়েছে ‘অটোম্যান সাম্রাজ্যে’, যেখানে অটোর সংখ্যা যত অটোম্যান সম্রাটের সংখ্যাও ঠিক ততজন। এখানেই যত বিপত্তি। কারণ, তারা সবাই যখন নিজেদের ‘আমরা সবাই রাজা’র আদলে ‘আমরা সবাই অটোম্যান সম্রাট, আমাদের এই অটোর রাজত্বে’—এমন সুর তুলে গান গায়, তখন আসলে সাধারণ পথচারী ও যাত্রীদের প্রাণ যায়।
এবার ঈদের ছুটিতে রওনা হয়েছিলাম বরিশালের উদ্দেশে। ভাবলাম নদীনালার জনপদ। নিশ্চয়ই অটো থেকে কিছুদিনের জন্য দূরে থাকব। দিনের বেলা বরিশাল যাওয়ার তেমন কোনো ভালো লঞ্চে টিকিট পেলাম না। অগত্যা বাসে করেই সন্ধ্যায় রওনা করলাম, যা রাত ১০টায় বরিশাল পৌঁছার কথা। মাঝপথ তথা টেকেরহাট পর্যন্ত মোটামুটি ভালোভাবেই আসা হলো। যাত্রাবিরতির পর বাস যতই বরিশালের দিকে এগিয়েছে, বাসের গতি ততই ধীর হয়েছে রাস্তায় চলা বেপরোয়া অটোর কারণে। বরিশাল পৌঁছার আগে বাটার জোড় নামক স্থানে বাস পুরোপুরি থেমে গেল সামনে দুর্ঘটনা ঘটায়। জানলাম অটো বাঁচাতে গিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে বাসে ও ট্রাকের মধ্যে। ফলে রাস্তা বন্ধ। অনেকক্ষণ পর উদ্ধারকারী গাড়ি (রেকার) এলো। তবে ততক্ষণে দুর্ঘটনা স্থলের দুই পাশের পুরোটাই চলে গেছে অটোম্যানদের দখলে। ফলে ‘রেকার’-এর পক্ষে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে গেল।
এদিকে রাত ১০টা বাজার ১৫ মিনিট আগেই ঝালকাঠি থেকে গাড়ি নিয়ে বরিশাল এসে হাজির আমার প্রিয় বন্ধু। কিন্তু আমি পড়ে আছি বাটার জোড়ে। ফলে টেলিফোনে বারবার কথা হলেও দুই বন্ধুর জোড়া আর লাগছিল না। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের অসহায়ত্ব দেখে বেশ খারাপ লাগল। চারদিকে এত অটোম্যান দেখে জড়তা কিংবা ভয়ের কারণে কার্যকর কিছুই করতে পারছিল না। মনে মনে ভাবলাম, এ পুলিশ দিয়েই হবে আগামী দিনের নির্বাচন? তাহলে ‘অটো’ মার্কা নিয়ে কেউ যদি মাঠে নেমে যায়, তবে ইশরাকের মতো নিজ দায়িত্বে ও নিজ সময়ে যথাযথ চেয়ারে বসে যাওয়া কোনো ব্যাপারই হবে না। দ্বিধা, লজ্জা, ভয়—এ তিন অটোম্যানদের থাকতে নয়।
এরপরের দৃশ্যটা আরও মজার। এবার পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন অটোম্যানদেরই একটি নতুন অংশ। হাতে লাঠি নিয়ে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি আর ধমকের পর ধমক দিয়ে রাস্তা বের করে দিল রেকারের জন্য। রেকার সামনে এগিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িগুলোকে একপাশে সরিয়ে দিল এবং আরেকটু সামনে গিয়ে রাস্তার পাশে অবস্থান নিল। এতে একদিকে রাস্তা খালি হলো বটে, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উভয় দিকের অটো ‘কার আগে কে যাবে’ প্রতিযোগিতায় নামে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে অবতীর্ণ হলো বেশ কিছু মোটরবাইক। অটো আর মোটরবাইকের মুখোমুখি অবস্থানে আবারও অচল গোটা রাস্তা। কেউ কাউকে ছাড় না দেওয়ায় আবারও বাসে গিয়ে বসে থাকতে হলো বেশ কিছুক্ষণ। এবারও দেখলাম তামাশা দেখছে পুলিশ। শেষমেশ ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবারও নেমে পড়লেন কতিপয় ‘অটোম্যান’। রাস্তা পরিষ্কার হলো, কিন্তু মনে জন্ম দিল হাজারো প্রশ্ন?
বরিশাল ও ঝালকাঠি অঞ্চলে গাড়ি নামক দানব আকৃতির কিছু বিরাটাকার যান(?) দেখেছি। সম্ভবত সেচ কাজের জন্য আমদানি করা বড় আকারের পানি তোলার পাম্পের ইঞ্জিন সামনে বসিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এসব যান নামক মরণফাঁদ! বিশাল আকারের গাছের গুঁড়ির স্তূপ, তেলভর্তি কয়েক ডজন ড্রাম, শতাধিক সারের বস্তা নিয়ে গগনবিদারী ভটভট শব্দ করে জাতীয় মহাসড়কে অতি দ্রুত ছুটে চলে এসব দানবাকৃতির কৃত্রিম যান। ব্রেকের বালাই আছে বলে মনে হয় না এসব কৃত্রিম যানে। আর ব্রেক চাপলেও পেছনে থাকা পণ্যের ওজনের কারণে সামনে বা পাশে যে ধাক্কা লাগবে, তাতে কোনো ব্রেকিং সিস্টেম কাজ করবে না, এটি নিশ্চিত। অথচ প্রশাসনের কেউই এমন যানবাহন কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে হলো না। আর জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চিত জবাব মিলবে—‘এ বিষয়ে আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্তের ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ফরিদপুর শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে চাখার নামক গ্রামে গিয়েছিলাম শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ি দেখার জন্য। গাড়ি নিয়ে এই ২৪ কিলোমিটার রাস্তা যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগেছে শুধু অটোম্যানদের সামাল দিতে গিয়ে। আরও আধা ঘণ্টা লেগেছে দেনদরবার শেষ করতে। একটি বাজার অতিক্রমের জন্য বেশ কিছু অটোর পেছনে লাইন ধরে বসে আছি। সামনের অটোগুলো থেকে অটোম্যানরা যে যার মতো করে যাত্রীদের ওঠানামা করাচ্ছেন। উল্টো দিক থেকে অটো ও মোটরসাইকেল আসছে। একটি মোটরসাইকেল যখন উল্টোদিক থেকে একটু ধীরগতিতে আমাদের গাড়ির (কার) পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই এ মোটরসাইকেলকে ওভারটেক করতে উল্টো দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে এলো আরেকটি অটো। কিন্তু রাস্তা অপ্রশস্ত হওয়ায় অটোর বডির লোহার ফ্রেমে লেগে খুলে গেল আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের পাশে থাকা লুকিং গ্লাস। মাটিতে পড়ে মুহূর্তেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো দামি আয়না। অটোচালক নির্বিকার! মুহূর্তেই জমায়েত হলো ডজনখানেক অটোম্যান। তাদের শারীরিক ভাষা বলে দিল আমরা যেন বেয়াক্কেলের মতো গাড়ি নিয়ে এ উপজেলা সড়কে ঢুকেছি। এটি তো অটোম্যানদের সাম্রাজ্য। এখানে তো শুধু অটো চলবে। গাড়ি কেন? আমরাইবা কেন? শেরেবাংলা কি এমন একটা দেশই দেখতে চেয়েছিলেন?
অবাক হয়ে দেখছিলাম অটোম্যানদের সব অদ্ভুত কর্মকাণ্ড। ওদের দেখে ছোটবেলায় দেখা একটি বাংলা সিনেমার গানের কথা মনে হলো—‘মিঠা লাগে যত ব্যথা দিসরে কালা।’
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর
গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন