দেশে সড়কে বিপদ বাড়ছেই। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হচ্ছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার খবর। গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা যে খবর পাই, তা কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশ। বাস্তবতায় এর পরিমাণ আরও বেশি। প্রাণহানি, আহতদের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ক্ষতি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মানসিক ও আর্থিক বিপর্যয়—এসব মিলে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের সমাজের জন্য এক ভয়ানক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিশ্রুতি আর সম্ভাবনা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এত আইন হলো, এত পরিকল্পনা নেওয়া হলো, কিন্তু কোনো কিছুই কাজে লাগছে না। এটা যেমন আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা, তেমনি সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলাও বটে। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে মারা গিয়েছিল দুই কলেজ শিক্ষার্থী। সে ঘটনা দেশবাসীকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সরকার সড়ক পরিবহন আইন করতে বাধ্য হয়েছিল।
শনিবার কালবেলায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে জাতীয় মহাসড়কে ২০৯টি দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়, যে সংখ্যাটি জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৬-এ। অর্থাৎ চার মাসের ব্যবধানে দেশের জাতীয় মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ফাউন্ডেশনের পাওয়া গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দেশের জাতীয় মহাসড়কে মোট ১ হাজার ৩৯৭টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২১৪টি, মার্চে ২২৮টি, এপ্রিলে ২১৩টি এবং মে মাসে ২৩৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় মহাসড়কগুলোর মান যে হারে উন্নত হয়েছে, সেই হারে এসব সড়কে চলা গণপরিবহনগুলোর মান বাড়েনি। ফলে দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়েছে। আবার জাতীয় মহাসড়কে চলার মতো উপযুক্ত ফিটনেস নেই বেশিরভাগ গাড়ির। সেইসঙ্গে চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। এতে অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অদক্ষ চালক। এমন বহু যানবাহন প্রতিদিন রাস্তায় চলছে, যেগুলো কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। দ্বিতীয়ত, বেপরোয়া গতি এবং ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। চালকদের মধ্যে ট্রাফিক আইনের প্রতি অজ্ঞতা কিংবা ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞার কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তৃতীয়ত, দেশের সড়ক অবকাঠামোর মান অত্যন্ত নিম্ন। অধিকাংশ রাস্তাই নিয়মিত মেরামত করা হয় না, ফলে সেগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল এই আইন পাসের পর সড়কে দুর্ঘটনা কমবে, যাত্রী ও পথচারীরা নিরাপদ থাকবেন। কিন্তু বিগত সরকার নানা মহলের চাপে সেই আইনটিকে কাটছাঁট করে একটি অকেজো আইনে পরিণত করে। ফলে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি আরও বেড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দশ মাস পেরিয়ে গেলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা নিরাপদ করতে দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ এখনো অনুপস্থিত।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃতি ও এর কারণ বিশ্লেষণ করে প্রতিকারের পথ খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি। এটা কেবল প্রশাসনিক সমস্যাই নয়; এটি আমাদের সামগ্রিক সামাজিক ব্যবস্থার একটি বড় ঘাটতি। প্রতিকার নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসন, জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন