ড. মো. গোলাম ছারোয়ার
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ডেঙ্গু প্রতিরোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ

ডেঙ্গু প্রতিরোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ

ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। বাংলাদেশে বড় দাগে মশাবাহিত রোগগুলো হলো—ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ফাইলেরিয়াসিস, ম্যালেরিয়া, জাপানিজ এনসেফালাইটিস প্রভৃতি। এ রোগগুলো যেসব মশা দিয়ে বাহিত হয় সেগুলো সাধারণত এডিস, কিউলেক্স এবং অ্যানোফিলিস। বর্তমানে সবচাইতে বেশি যে রোগটি আমাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হলো ডেঙ্গু। যার বাহক এডিস ইজিপ্টাই এবং এডিস এলবোপিকটাস। সত্য বলতে কী, এডিস মশার আনুপাতিক ঘনত্ব কিউলেক্স মশার তুলনায় অতি নগণ্য। কিন্তু তারপরও কেন তার তাণ্ডবতা দিন দিন বেড়েই চলছে। বেড়ে চলেছে মৃত্যু মিছিল। এদিকে কিউলেক্স মশার অত্যাচার আর উপদ্রবে মনে হয় পুরো ঢাকা শহর ওরা দখলে নিয়েছে। কোনো কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নয়। সবকিছুই তাদের দখলে। দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোও চলে গেছে অ্যানোফিলিস মশার আওতায়। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে আমরা সবাই মশার রাজ্যে ভাড়াটিয়া। কেন এমন ভয়ানক পরিস্থিতি। শুনেছি আমাদের দেশে একটি মশক নিবারণ অধিদপ্তর রয়েছে। কতটা কার্যকর এ অধিদপ্তর এবং কতটা সুফল পাচ্ছে দেশবাসী, তা সত্যিই জানার সময় এসেছে। মশক দমনে কার্যকর পদক্ষেপ অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে। বিজ্ঞান অবশ্যই ডাটাবেসের ওপর ভিত্তি করেই পদ্ধতি নিরূপণ করবে। ২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মোট আয়তন ১৯৬.২২ বর্গ কিলোমিটার, মোট অঞ্চল ১০টি, মোট ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪টি, মোট বাড়ির সংখ্যা ১,৬৩৬৯২৪টি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট অঞ্চল ১০টি, মোট ওয়ার্ড সংখ্যা ৭৫টি, মোট বাড়ির সংখ্যা ১,১০৪৭০৩টি। ওপরের পরিসংখ্যান থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, উত্তর সিটি করপোরেশন আয়তনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তুলনায় ৮৭.০২ বর্গ কিলোমিটার বেশি এলাকাজুড়ে অবস্থিত। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সংখ্যা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তুলনায় কম।

এবার আসি বাড়ির সংখ্যার সঙ্গে মশক নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক কী? উত্তর খুবই স্পষ্ট। কিছুদিন পূর্বে ১৯ জুন ২০২৫ থেকে ২৭ জুন ২০২৫ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশক নিধন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। প্রশিক্ষণ কর্মশালায় কর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারি ৬০ সিসি লার্ভিসাইড হিসেবে প্রদত্ত টেমিফোস (একটি অর্গানো-ফসফেট কীটনাশক) প্রতি ১০ লিটার পানির মধ্যে ১৫ সিসি মিশিয়ে স্প্রে করতে হয় এবং প্রতিদিন এক-একজন কর্মী মোট টেমিফোস স্প্রে করে ৬০ সিসি। অর্থাৎ ৪০ লিটার পানিতে ৬০ সিসি লার্ভিসাইড। তাদের ভাষ্যমতে, প্রতিদিন এই ৪০ লিটার পানিতে মিশানো ৬০ সিসি লার্ভিসাইড দিয়ে গড়ে ৪০ থেকে ৬০টি বাড়ি স্প্রে করা সম্ভব। যদিও তাদের প্রদত্ত লগ বুকে মাত্র এক থেকে দুটি বাড়ির মালিক বা কেয়ার টেকারের সই থাকে। বিষয়টি সত্যিই ভাবিয়ে তোলার মতোই। এদের কোনো যথাযথ পর্যবেক্ষণও নেই। যা-ই হোক, যদি প্রতিদিন একেকজন কর্মী ৬০টি বাড়িই স্প্রে করেন, তাহলেও উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট নিযুক্ত মশক নিধন কর্মী ১১০০ জনের একবার করে সব বাড়ি স্প্রে করতে সময় লাগবে কমপক্ষে ২৪ দিন। এই ২৪ দিনে মশা তার জীবনচক্র শেষ করে, রোগ ছড়িয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে ফেলবে অনায়াসেই। একই হিসেবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নিযুক্ত ৮৭৩ জন মশক নিধন কর্মীর ১৯ লাখ ৪ হাজার ৭০৩টি বাড়ি স্প্রে করতে কমপক্ষে সময় লাগবে ২১ দিন। এর মধ্যেই মশক তার সব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম মনের আনন্দেই শেষ করবে এবং করেই চলেছে বলে ডেঙ্গুকে আমরা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে সফল হয়েছি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে সমাধান কী। সমাধান অবশ্যই আছে। তবে তারও আগে সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে মশক নিবারণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব কী এবং কতজন জনবল নিয়ে কী সফলতা বয়ে এনেছেন মশক নিধন কার্যক্রমে। অধিদপ্তর ঢাকায় অবস্থিত। অথচ ঢাকাতেই মশক নিধন কার্যক্রম কতটা নাজুক। এ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে কাঠামো। কর্মটিই তাদের মশা মারা। তাই কর্মীসহ কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বাড়ানো আশু প্রয়োজন। প্রয়োজন গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুবন্দোবস্ত করণের। তাদের নিজস্ব জনবল ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মশার ঘনত্ব জরিপ থেকে শুরু করে নিধন কার্যক্রমের প্রতিনিধিত্ব করবে এ অধিদপ্তর। কারণ মশা ডেঙ্গু ভাইরাসসহ প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। সিটি করপোরেশনের বাইরে মশক নিধনের সব কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া উচিত এ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে। তাই প্রয়োজন এখনই এর আমূল সংস্করণ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন এ অধিদপ্তর স্বাস্থ্য ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে বৈজ্ঞানিকভাবে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করার মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জিত হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতিটি বাড়িতে সপ্তাহে দুবার লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করতে হলে মোট মশককর্মী প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ৯ হাজার এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সপ্তাহে দুদিন লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করতে প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ৬ হাজার মশক নিধন কর্মী। তারপরও থাকতে হবে অত্যন্ত চৌকস পর্যবেক্ষণ। কারণ, হিসাব অনুযায়ী একজন কর্মী প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০টি করে বাড়ি স্প্রে করবেন। শুধু একটি বা দুটি বাড়ি স্প্রে করলে কখনোই কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা তো দূরের কথা অবস্থা প্রতিদিন এমনি পরিস্থিতির দিকে মোড় নেবে, যা থেকে কোনোভাবেই রক্ষা নেই। একই সঙ্গে ময়লা-আর্বজনা পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সংখ্যা এবং পানি ব্যবস্থাপনা কর্মীদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে এবং তাদের কাজের পর্যবেক্ষণ তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। নগরে মশা উৎপাদনের কারখানা অব্যাহত রেখে কখনোই মশা নিধন করা সম্ভব নয়। তাই নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পরিবেশবাদীরা অবশ্যই সমন্বিত কার্যক্রমে যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিডিসি বা আইইডিসিআর নিপসম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় মশক ঘনত্বের জরিপ করে, সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করে সিটি করপোরেশন সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে মশক নিবারণ অধিদপ্তর কী ভূমিকা রাখছে মশা নিয়ন্ত্রণে। মশাকে নিয়ে গবেষণা থেকে শুরু করে মশার বায়োলজি, মশার ইকোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মশার আচরণ, পরিবেশের সঙ্গে তার অভিযোজন প্রভৃতি বিষয়ে বাস্তব ও প্রায়োগিক গবেষণা, গবেষণালব্ধ ফল বিশ্লেষণে প্রয়োজনীয় কৌশল প্রণয়ন। জনবল তৈরি ও কর্মপরিধি নির্ধারণ এবং মূল্যায়ন যথাযথ না হলে অবস্থা যেমন আছে, দিন দিন তার চেয়ে খারাপ হতেই থাকবে।

কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হলে বছরে তিনটি মশার ঘনত্ব পরিমাপের জরিপ একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে করে এর ক্রস চেকিংয়ের মাধ্যমে পলিসি নির্বাচন করতে হবে। পলিসির বাস্তবসম্মত বহুমুখী বা হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ প্রয়োগ করতে হবে। একক কোনো পদ্ধতি কখনো কার্যকর হতে পারে না। এক্ষেত্রে আইপিএম এবং আইভিএমের সমন্বয়ে আইপিভিএম বা সমন্বিত বালাই ও বাহক ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করা জরুরি। এতগুলো কাজের সমন্বয় ওই প্রতিষ্ঠানকেই করতে হবে, যে প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে মশক নিবারণ অধিদপ্তর হিসেবে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে শুধু ভেক্টরবাহিত রোগ ও ইমার্জিং রি-ইমার্জিং সংক্রামক রোগসমূহ নিয়ে সার্বিক গবেষণা ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত হবে। হ্যাঁ, এখনই সময় জনস্বাস্থ্যে ব্যবহৃত কীটনাশকগুলোর সক্রিয় উপাদান পরীক্ষা, তার উন্নয়ন, প্রয়োগ পদ্ধতি, সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদ উন্নয়ন, মশার প্রজনন ধ্বংসসহ সব অংশীজনের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান নির্মোহভাবে কাজ করার। এটি হতে পারে মশক নিবারণ অধিদপ্তর বা আলাদাভাবে জাতীয় ভেক্টর ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ নামে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসস, আইইডিসিআর, সিডিসি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। শত্রুটি হলো মশা নামক একটি পোকা। একে দমন করতে হলে ঢিলেঢালা পদ্ধতিতে কোনো কাজ হবে না। গ্রহণ করতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। সব পরিসংখ্যানিক উপাত্ত সামনে রেখে সে অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগই আনবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান

কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসম, মহাখালী ঢাকা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় আরও একজনের মৃত্যু

সপ্তাহে ২ দিন ছুটি, নিয়োগ দিচ্ছে পপুলার ফার্মা

ঢাকার সড়কে ম্যারাথনে দৌড়ালেন আসিফ মাহমুদ

জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী না হলেও সবচেয়ে বেশি ভুগছে আফ্রিকা

ঢাকার বাতাস সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’

কেন ৩০০ কেজি সোনার গহনা পরেছিলেন ঐশ্বরিয়া?

ফিরে দেখা ১৮ জুলাই / ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষ, নিহত ৩১

টঙ্গীতে পরকীয়ার জেরে হত্যা, মামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

ইউক্রেনে শান্তি প্রচেষ্টা নষ্ট করছে যুক্তরাষ্ট্র : রাশিয়া 

টেস্টিং সল্ট স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী না ক্ষতিকর? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

১০

তরুণ অভিনেতার সঙ্গে কারিনার প্রেম

১১

‘বাংলাদেশ রেলওয়ে একমাত্র সেবা যেখানে যাত্রী আসার পর বলা হয় বগি নষ্ট’

১২

নবজাতক কন্যার ছবি তুলতে নিষেধ করলেন সিদ্ধার্থ-কিয়ারা

১৩

রাজধানীতে এনসিপির বিক্ষোভ সমাবেশ আজ

১৪

গোপালগঞ্জ দেশের মানচিত্রে না থাকাই ভালো : আমির হামজা

১৫

মানিকগঞ্জে আষাঢ়েও পানিশূন্য বিল, বিপাকে কৃষক ও জেলেরা

১৬

আজ মিলবে বিনামূল্যে ইন্টারনেট, যেভাবে পাবেন

১৭

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৮

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৫৬

১৯

সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলা থেকে নিজেকে দূরে সরাল যুক্তরাষ্ট্র

২০
X