(পূর্বে প্রকাশের পর)
একটি কথা মনে রাখতে হবে, বিএনপি যতটা না নেতাকর্মী নির্ভর তার চেয়েও বেশি সমর্থক নির্ভর। এই সমর্থকরা পর্যন্ত বিগড়ে যায়। এর বিপরীতে বিএনপি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বিএনপির সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, ২০০৬ সালে ড. ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। ওই সময়ের প্রতিপক্ষ সৃষ্ট সহিংসতা-হানাহানির বিপক্ষে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করেনি। অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফররা বিশ্বাসঘাতকতা করার পরে সিরাজউদ্দৌলার যে অবস্থা, ঠিক তেমনি। দেশীয় ও বহিঃশত্রুর হাত ধরে ১/১১-এর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দলটির নাম বিএনপি।
এর পরের ফ্যাসিবাদের ১৫ বছর বিএনপি কার্যকর কিছু করতে পারেনি। ২০১৪ নির্বাচনের আগে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর দৌড়ঝাঁপের বিপরীতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। নির্বাচনে নেওয়ার জন্য বেগম খালেদা জিয়া ও এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভিন্ন দেশি কূটনীতিকরা। কিন্তু এটা যে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ, তা-ও জোরের সঙ্গে বলতে পারেনি বিএনপি। কর্মীরা গুম-খুনের শিকার হতে থাকে। ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪-এর নির্বাচন কি করতে পেরেছে বিএনপি? নির্বাচনের দিনে হরতাল আর ঢাকা ঘেরাও এবং নেতাদের জেলে যাওয়া ছাড়া কী অর্জন হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার এবং তাকে বিদেশে নিয়ে যেতে পারার জন্য তারা, না দেশীয় কার্যকর আন্দোলন অথবা পশ্চিমা দুনিয়াকে বোঝাতে পেরেছে যে, আসল পরিস্থিতি এমন নয়। ‘জঙ্গি’ সৃষ্টির জন্য বিএনপিকে দায়ী করে অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুম, ক্রসফায়ার, হত্যা, নির্যাতন, হামলা, মামলা চালানো হয়। বিএনপির প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ওঠে। বিএনপি ওই সময় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে দেশে-বিদেশে জনমত তৈরি করতে পারত। কেন্দ্রের সঙ্গে ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীদের দূরত্ব তৈরি হয়। এসব ঘটনা সবার জানা।
শেষ পর্যন্ত ২০২৪-এর জুলাইয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন পরিণত হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ববিহীন সাধারণ ছাত্র-জনতার মিলিত ঐক্য দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করে ফ্যাসিস্ট সরকারকে। এই আন্দোলন তরুণদের উত্থান, তাদের বিজয়। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার মিলিত ‘নয়া রাজনীতির’ বিজয়ে পরিণত হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর প্রথমে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল বললেন, ‘এই বিপ্লবের সঙ্গে আমাদের (বিএনপির) কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ যে আন্দোলনের জন্য তরুণদের সঙ্গে দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানানোর কথা, সেখানে বিষয়টি পরিণত হয় উল্টো। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার আগের দিনই অর্থাৎ ৭ আগস্ট বিএনপি নয়াপল্টনে এক সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে সংসদ নির্বাচন দিতে হবে বলে দাবি জানান। রক্তের দাগ শুকালো না, ফ্যাসিস্ট বিতাড়নের আনন্দে দেশ যখন ভিন্ন এক মেজাজে, তখনই নির্বাচনের দাবি করা কতটা সংগত হয়েছে? এতে যে বার্তাটি সাধারণ নেতাকর্মীদের কাছে গেছে, তাতে মনে হয়েছে, খুব স্বল্প সময়ে বিএনপি ক্ষমতায়। এতে নেতাকর্মীরা বেপরোয়া-বাঁধনছাড়া হয়ে পড়ে। বিএনপির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট যে নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল, তা-ও ঘটনা ঘটার পর হচ্ছে। সমুচিত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বা ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি এবং হচ্ছে না। তারেক রহমান লন্ডনে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতটুকু বলেন, তাতে কতটুকু কাজ হচ্ছে—তা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈন্যসংখ্যা যতই হোক, সেনাপতি অনুপস্থিত থাকলে সে যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আগেই বলেছি, রাজনীতি হচ্ছে মানুষের ভাবনা, চিন্তা, উপলব্ধির বিষয়। এখন যা কিছু অঘটন ঘটছে, তা বিএনপির বিপক্ষের পারসেপশন হিসেবে জনগণের মনে ঢুকবে। এটা জনগণের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়—এখানে কারও হাত নেই। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বয়ান তৈরিতে আদৌ আগ্রহী কি না, সন্দেহ আছে।
একবার মির্জা ফখরুল বললেন, এই আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ প্রকারান্তরে জুলাই বিপ্লবকে তারা স্বীকৃতি দিতে রাজি নন। এখন আবার বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, এটা বিএনপির ১৫ বছরের আন্দোলনের ফসল। বেগম খালেদা জিয়া যেখানে টেলিভিশনে তরুণদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, সেখানে বিএনপির নেতাদের বক্তব্য ও মনোভাব নেতিবাচক। বিএনপির নেতারা বহিঃশত্রু এবং এ দেশীয় ব্যক্তিদের ফাঁদে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছেন। এতে তাদের ইতিবাচক পয়েন্ট যোগ হচ্ছে না—বিয়োগ হচ্ছে।
বিএনপি সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে একা হয়ে পড়েছে। জামায়াত, এনসিপি, বিভিন্ন ইসলামী দলের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি লন্ডনে ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের ‘খুবই ফলপ্রসূ’ আলোচনা এখন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বিএনপি বড় দল হিসেবে যদি একলা চলো নীতি গ্রহণ করে, তা হবে আত্মঘাতী। বিএনপি নির্বাচনকেই মুখ্য এবং প্রধান বিষয় হিসেবে গণ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের পরে সরকার পরিচালনার মূলনীতি, সংবিধান, সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য, অর্থনীতি, শিল্প, প্রতিরক্ষা নীতি কী হবে—তা নিয়ে কোনো হোমওয়ার্ক করছে বলে জানি না। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, কিছুই হচ্ছে না।
নির্বাচন সম্পর্কে দুজন বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কের মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম প্রেসিডেন্ট Theodare Roosevelt বলেছেন, Vote is like a rifle; its usefulness depends upon the character of the user. (নির্বাচন হচ্ছে একটি রাইফেলের মতো; এটা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নির্ভর করে যে ব্যবহার করবে তার ওপর।) তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা Joseph Stalin বলেছেন, Those who vote decide nothing. Those who count the vote decide everything (যারা ভোট দেয় তারা কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে না। যারা ভোট নেয় ও গণনা করে তারাই সবকিছুর নির্ধারক)।
কাজেই নির্বাচনের আগে একটি টেকসই, লাগসই রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া শুধু নির্বাচন হবে অর্থহীন। বিএনপি বড় দল—তারা জিতবেই, এটা তারা মনে করছে। কিন্তু ওই সরকারকে জেনারেল জিয়ার ১৯ দফা এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ১৬ দফা বাস্তবায়ন করতে যে প্রস্তুতি, তা কি বিএনপির আছে? আগেই বলেছি, সময়ের পরিক্রমায় মানুষ ১৯৭৭-৭৮-এ নেই। পরিবর্তিত সময়ে মানুষের চাহিদা বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২৫ বছরের নিচে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৬ কোটি (৫৯ দশমিক ৬০ মিলিয়ন)। তাদের কাছে টানতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। এই তরুণ সমাজ রাজনীতি সচেতন; কিন্তু রাজনৈতিক দলবিমুখ। এদের কাছে টানার কোনো ক্যারিশম্যাটিক বা আকর্ষণীয় জাদুকরী কোনো নেতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি।
আগেই বলেছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। সঙ্গে আছে বহিঃশক্তির নানা কলাকৌশল। কোন্দল হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে। এটা ওই বহিঃশত্রুর ফাঁদ পাতা কলের মধ্যে কি পা দিয়েছে বিএনপি? বড় দল হিসেবে বিএনপিকেই জামায়াত, এনসিপিসহ সব দলের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে হবে। বিএনপি বড় দল হিসেবে এটা যদি না করে, আখেরে বিএনপিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন দাম্ভিকতার সময় নয়, প্রয়োজন ঐক্য ও সমঝোতার। না হলে লাভবান হবে বহিঃশক্তি এবং তার সঙ্গী পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি। তারা যত শক্তিশালী হবে, বিএনপিসহ এই ধারার দলগুলো দুর্বল হবে। [শেষ]
লেখক: গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন