অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:৫৫ এএম
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:১৪ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পজিটিভ বাংলাদেশ, বড় হয়ে উঠুক

পজিটিভ বাংলাদেশ, বড় হয়ে উঠুক

মিডিয়া মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন এটিই সত্য। এই মিডিয়া এক সময় ভালো মানুষের পেছনে ঘুরত। এখনো যে ভালো কিছু প্রমোট করে না, এটি বলা যাবে না। চট্টগ্রামের আজাদী বা ঢাকার সংবাদ তেমন জাতীয় সংবাদপত্র, যারা নেগেটিভ বিষয় পপুলার করে না। করে না বলেই যুগের পর যুগ টিকে আছে। এমন না যে অন্যান্য মিডিয়া এ বিষয়ে পিছিয়ে। তবে এটি সত্য যে বেশিরভাগ সময়ই আমাদের দেশে নেগেটিভ বিষয় প্রাধান্য লাভ করে।

খেলাধুলার প্রতি মানুষের মনোযোগ চিরকালীন। আমাদের যৌবনেও ক্রিকেট ছিল আকর্ষণ। সে সময়কার বাংলাদেশে এমন কোনো সংগতি ছিল না যে আমরা ভালো বল ব্যাট বা উইকেট জোগাড় করে অনায়াসে তা খেলতে পারব। তারপরও মানুষের আগ্রহ আর ভালোবাসায় গড়ে উঠেছে ক্রিকেট জগৎ। আজকে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ক্রিকেটে উল্লেখযোগ্য একটি নাম। সারা বিশ্বের ক্রিকেট জগৎ এক নামে সাকিব আল হাসানকে চেনে। আমাদের দেশের সাফল্যও কম কিছু নয়। কিন্তু আপনি খেয়াল করবেন, ধারাবাহিক ব্যর্থতার পাল্লাটাও বেশ ভারী। এ লেখা যখন লিখছি এশিয়া কাপের খেলায় শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় মানের বোলিংয়ের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে বাংলাদেশ, যা ছিল অপ্রত্যাশিত। ফলাফলে জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, খেলা-পরবর্তী বা খেলার আগে যে জোয়ার, যে উন্মাদনা তার সিকিভাগও নেই আর কোনো বড় বিষয়ে। কী সেই বড় বিষয়?

বহুকাল আগে চট্টগ্রামের ফুলকিতে এসেছিলেন সাহিত্যিক গৌর কিশোর ঘোষ। এক সন্ধ্যার আড্ডা ও কথোপকথনে তাকে জানার সুযোগ ঘটেছিল। বলাবাহুল্য তখন বয়স কম, যৌবনের বেয়াড়া সময়। তর্ক করতে পছন্দ করতাম। তার মতো মানুষের সঙ্গেও তর্ক লেগে গিয়েছিল আমার। বাম আদর্শ ও বাম ধারার বিরুদ্ধে তার মতামত সহ্য করতে পারিনি বলে অসম তর্কে পরাজিত হব জেনেও হাল ছাড়িনি। কোনো কোনো সময় তর্ক আসে উপকারে। পরদিন তিনি যে সব ছড়া শুনিয়েছিলেন তা আমার স্মৃতিতে জাগরূক। তার কথা বললাম এ কারণে সেদিন জেনেছিলাম এশিয়ার নোবেল নামে পরিচিত র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের আদ্যোপান্ত। কারণ তিনি ছিলেন এর একজন নির্বাচক।

র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারটি তৃতীয় ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতির স্মৃতি এবং নেতৃত্বের উদাহরণ দিতে উদযাপন করা হয়, যার নামানুসারে এই পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে এবং প্রতিবছর এটি এশিয়ার এমন একজন ব্যক্তি বা একটি সংস্থাকে দেওয়া হয়, যারা একই নিঃস্বার্থ সেবা প্রকাশ করে, যা প্রয়াত এবং প্রিয় ফিলিপিনো নেতার জীবনকে শাসন করেছিল।

এবার আমাদের দেশের এক তরুণ এই পুরস্কার পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে আমরা তার নাম জানি না। জানলেও চিনি না। আর চিনলেও খবর রাখিনি। চলতি বছর এই পুরস্কার প্রবর্তনের ৬৫তম বার্ষিকীতে করভিকে ‘উদীয়মান নেতা’ হিসেবে এই স্বীকৃতি দিয়েছে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই কর্তৃপক্ষ।

এবারের র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেয়েছেন আরও তিনজন— ভারতের রবি কান্নান আর., পূর্ব তিমুরের ইগুয়েনিও লেমোস ও ফিলিপাইনের মিরিয়াম করোনেল-ফেরের।

করভি রাখসান্দ। কে এই যুবক? করভি রাখসান্দ হলেন একজন বাংলাদেশি, জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য উদীয়মান নেতা হিসেবে ২০২৩ সালে তিনি র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেছেন। করভি স্কলাস্টিকা স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি আইন বিষয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এ স্নাতক ডিগ্রি নেন। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তিনি জাগো ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। করভিকে নিয়ে আলাপ করার আগে বলি বাংলাদেশের আরও ১২ জন বিখ্যাত মানুষ এই পুরস্কার জিতেছিলেন । তাদের কথা কি মনে আছে আমাদের? এর আগে বাংলাদেশ থেকে মোট ১২ জন এই পুরস্কার পেয়েছেন। তারা হলেন—সমাজসেবী তহরুন্নেসা আবদুল্লাহ (১৯৭৮), ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ (১৯৮০), গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (১৯৮৪), গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (১৯৮৫), ক্যাথলিক ধর্মযাজক রিচার্ড উইলিয়াম টিম (১৯৮৭), দিদার কমপ্রিহেনসিভ ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইয়াসিন (১৯৮৮), বেসরকারি সংগঠন বাঁচতে শেখার প্রতিষ্ঠাতা অ্যাঞ্জেলা গোমেজ (১৯৯৯), বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (২০০৪), প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান (২০০৫), বেসরকারি সংগঠন সিডিডির নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান (২০১০), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান (২০১২) ও বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরী (২০২১)।

তালিকাটা দেখলে বা নামগুলো পড়লেই বুঝবেন তাদের কাজ ও কাজের পরিধি আমাদের সমাজকে কী দিয়েছে। কেন তারা এমন একটা পুরস্কার জিতে আমাদের জাতির সুনাম বয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশ ও সমাজ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদের হাতের কাছে সহজলভ্য এমন কিছু মানুষ মিডিয়া যাদের ছাড়া ১ মিনিটও থাকতে চায় না। থাকতে পারে না। তাদের অবদান বা ত্যাগ যা-ই হোক তারাই আমাদের আইডল। আমি বলছি না যে তারা খারাপ। হয়তো তাদের অবদান ও আমাদের সমৃদ্ধ করে; কিন্তু যাদের কথা জানলে বা শুনলে তারুণ্য ভালো পথে যাবে উদ্বুদ্ধ হবে, তাদের কথা প্রচার করা হয় না। রাজনীতি আর তর্কের ভেতর ডুবে থাকা সমাজ এ কারণেই খোলস ভাঙতে পারে না।

করভি রাখসান্দকে আমি কোথাও দেখি না। তার প্রচার নেই। তার জাগো ফাউন্ডেশনের নাম জানি। জানি তারা সুবিধাহীন নিম্নবর্গের নামে পরিচিত শিশুদের পড়াশোনার জন্য কাজ করে। লেখাপড়া শেখায়। জাগো ফাউন্ডেশনের বর্তমানে সারা বাংলাদেশে বিস্তৃত স্কুল রয়েছে, যা ৪ হাজার ৫০০ সুবিধাবঞ্চিত শিশুর জন্য বিনামূল্যে পাঠদান সেবা দিয়ে যাচ্ছে। জাগোর প্রধান বার্ষিক ইভেন্টগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘সার্বজনীন শিশু দিবস’। ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক প্ল্যাটফর্ম ‘ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে ৫০ হাজারেরও বেশিসংখ্যক মানুষ যারা শিশুদের অধিকারের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই দিবসটি উদযাপন করে।

এটিই জানি, তাদের কার্যক্রম আর ব্যক্তিজীবন নিয়ে কিছু কথা চালু আছে। আছে অভিযোগও। সেসবের সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা আমাদের কাজ নয়। আমরা তা পারবও না। যেভাবে বিষয়টিকে দেখি তা খুব সহজ-সরল। এটা একজন বাংলাদেশির কৃতিত্ব। আমাদের দেশের একজন তরুণের সাফল্য। করভি রাখসান্দ সেই তরুণ, যে সাকিব আল হাসান বা আর কারও চেয়ে কম কিছু নয়। দেশ ও দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানো এই তরুণকে স্যালুট জানাই। যে আমাদের জাতির মুকুটে পরিয়ে দিয়েছে আরেক পালক। এটাই বাংলাদেশের জয়। মানুষের জয়। সে প্রমাণ করেছে কোনো কাজই বৃথা যায় না। সব ভালো কাজের ফল যোগ হয় আমাদের জীবন ও ভবিষ্যতে। জয়তু করভি রাখসান্দ। জয় হোক বাংলাদেশ ও বাঙালির।

লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক, সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সেই ভিক্ষুকের ঘরে মিলল আরও এক বস্তা টাকা

শিশুর উচ্চতা বাড়াতে প্রতিদিনের খাবারে রাখুন এই ৪ জিনিস

রাজধানীর আরও বেশ কিছু এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

গোসলে নেমে প্রাণ গেল ৩ বোনের

জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে অ্যাকশনে পুলিশ

ইশরাকের সঙ্গে বাগদান নিয়ে হবু স্ত্রীর স্ট্যাটাস

মোবাইলে আফগানিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচ দেখবেন যেভাবে

‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি : দুদু

র‍্যাবের গাড়ি-বাসের সংঘর্ষে শিশুসহ নিহত ৩

কাঁদতে কাঁদতে নিজের জীবনের যে দুঃখের গল্প শোনালেন মারুফা

১০

আমি কিছুটা ‘লক্ষ্মী’, কিছুটা ‘দুষ্টুও’: মনামী ঘোষ

১১

ডিরেক্টর আর্টিস্ট পয়দা করতে পারে না : যাহের আলভী

১২

মক্কা থেকে যা বললেন ফারহান

১৩

ইমা অ্যাওয়ার্ডে ‘নিশি’

১৪

পাকিস্তানে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা, ৭ সদস্য নিহত

১৫

ধামরাই ওদুদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের অ্যালামনাই পরিবার গঠন

১৬

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়টি জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে : আমীর খসরু

১৭

কোন জেলার জামাই হচ্ছেন ইশরাক

১৮

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে ‘ওয়ান-টু-তে’ সব সমস্যার সমাধান হবে : গোলাম পরোয়ার

১৯

সেপটিক ট্যাংক বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু, আহত ৫

২০
X