বিনিয়োগ বাড়ানোর দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নয়, মত গভর্নর ড. আহসান হাবিব মনসুরের। তাহলে এ দায়িত্ব কার? সেই প্রশ্ন তাকে সম্ভবত গণমাধ্যমের কেউ করেননি, তাই জবাবও দিতে হয়নি। তবে বাড়তি কথা হিসেবে বলেছেন, নির্বাচনের পর এমনিতেই দেশে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। ঘটনা ঠিকই ধরেছেন গভর্নর। এটাই হওয়ার কথা, মানে এটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক নির্বাচিত সরকার আর মধ্যবর্তী বা অস্থায়ী সরকার বলে কথা। এবার নীতি সুদহার ১০ ভাগ ধরে গত বৃহস্পতিবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই আনুষ্ঠানিকতাতেই বিনিয়োগ বিষয়ে কথাগুলো বলছিলেন ড. আহসান এইচ মনসুর। জানালেন, ব্যাংকগুলোকে আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হবে না। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ব্যাংকগুলো শক্তিশালী রূপে ফিরবে।
এবার অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও আগের মুদ্রানীতিতে এ লক্ষ্য ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচারে ব্যাংকগুলোর ভগ্নদশায় ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা না থাকায়, লক্ষ্য অর্জিত হয় মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। গভর্নর বলছেন, ঋণ নিয়ে অর্থ বিদেশে পাচার করায় অর্থনীতির সর্বনাশ হয়েছে। তা বুঝতে ডক্টরেট, অর্থনীতিক বা গভর্নর হতে হয় না। অর্থনীতি, হিসাবনীতি না জানা টাকা-আনা গুনতে পারা মানুষেরও তা বোধগম্য।
মুদ্রানীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসেবে জানানো হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং ব্যাংক খাতে আস্থা ফেরানোর কথা। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলে বাস্তব নীতিগত সুদের হার ৩ শতাংশে পৌঁছালে তখন পর্যায়ক্রমে সুদের হার কমানোর চিন্তা করা হবে বলেও জানানো হয়েছে। মুদ্রানীতিতে রক্ষণাত্মক ভূমিকার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, বৈদেশিক চাহিদা হ্রাস ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কার কারণে এ অবস্থান নিতে হয়েছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর বা রক্ষণাত্মক হতে বাধ্য করছে।
আশা তো এমন ছিল না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের এ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অর্থনীতি নতুন করে ধকলে পড়ে। আকস্মিক স্থবিরতা-হাহাকার নেমে আসে বেসরকারি খাতে। বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নতুন প্রকল্প থমকে যায়। চালু থাকা কারখানা চালু রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। এতে একদিকে কর্মসংস্থানে খরা নামে। বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ। একদিকে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামে। আরেকদিকে, ঋণের সুদহার বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়ায়। তার ওপর যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চহারের শুল্কের ঝড়। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে এখনো মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। তাই নীতি সুদহারে কোনো পরিবর্তন নয়, বেসরকারি খাতের পাশাপাশি দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকেও নজর দেওয়ার অবস্থা নেই। গভর্নর বুঝেশুনেই বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি না কমলে নীতি সুদহার রক্ষণশীলই থাকবে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা না থাকলে প্রবৃদ্ধির কথা ভুলে যেতে হবে। টাকা ছাপিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়, তবে সেটা টেকসই হবে না, তাও উল্লেখ করেন।
সরকারের কিছু পদক্ষেপে এরই মধ্যে লেনদেনে ভারসাম্য ও ডলারের দামে স্থিতিশীলতা আসা, মূল্যস্ফীতিতে একটু লাগাম পড়ার কথাও উঠে এসেছে। এখন যে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, সেটার মধ্যে কোনো ভেজাল নেই বলে দাবি গভর্নরের। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে আগামী বছর সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশাবাদ। আর মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে নামলেই নীতি সুদহার কমানো হবে। বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেই জানানো হলেও নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য আগামী ডিসেম্বরে ৭ দশমিক ২ এবং আগামী বছর জুনে ৮ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের মুদ্রানীতিতে গত জুনে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
মুদ্রানীতি কখনো সরকারি-বেসরকারি খাতের জন্য আলাদা নয়। তা সবার জন্য অভিন্ন। মন্দার হাতছানিও সমভাবে সবার জন্য। এখানে রাজনৈতিক কারণে হেরফের অবধারিত। কিছুটা অনিবার্যও। গত বছর ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেকের ব্যবসা সীমিত হয়ে পড়েছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার পর্ষদে পরিবর্তন হওয়া ১৪টি ব্যাংকের কোনোটির ঋণ কার্যক্রম বন্ধ, আবার কোনোটি ঋণ সীমিত করেছে। এর মধ্যে নয়টি ব্যাংক ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এস আলমের নিয়ন্ত্রণে। বাকিগুলোর একটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও দুটি ছিল সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে বাড়তি ধকলে।
অন্তর্বর্তী সরকার বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও বিনিয়োগের চাকা সচল রাখতে পারেনি। মিল-ফ্যাক্টরির দিকে যেন কারও কালো থাবা না পড়ে, উৎপাদনের চাকা যেন না থামে; তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ব্যাংক থেকে অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ বের করা অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখনো সন্তুষ্ট নন। এর জের পড়ছে পদে পদে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই ঋণে প্রবৃদ্ধি কমছে। গত বছর জুলাইতে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। এরপর গত ডিসেম্বরে তা ৭ দশমিক ২৮ শতাংশে নামে। পরের মাস জানুয়ারিতে আরও কমে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়। ফেব্রুয়ারিতে নেমে যায় ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে।
এরপর মে মাসে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ ও জুনে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন এই গভর্নরই। তাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানাই ছিল আসল লক্ষ্য। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাংক খাত থেকে চলতি অর্থবছরে সরকারে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সেটি কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ওই মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়ানো হলেও সাড়া জাগানো যায়নি। মুদ্রানীতি সেখানে আসল ফ্যাক্টর নয়। এর মূল কারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা আনতে না পারা।
কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে নেওয়া মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে ওই দেশের সর্বোচ্চ আর্থিক কর্তৃপক্ষ। আর বাংলাদেশে সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সেই কর্তৃপক্ষ হিসেবে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এখানে প্রতি ছয় মাস পরপর মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাধারণত জানুয়ারি-জুন ও জুলাই-ডিসেম্বর, এ সময়সীমা ধরে বাংলাদেশে মুদ্রানীতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ প্রথম মুদ্রানীতি দেওয়া হয় ২০০৬ সালে। তখন বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করত বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবির বছরে একবার মুদ্রানীতি প্রণয়নের ঘোষণা দেন। পরের কয়েক বছর এমনই ছিল। পরে ২০২৩ সাল থেকে আবার বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার রীতিতে ফিরে যায় বাংলাদেশ। বিশ্বে মুদ্রানীতি প্রণয়নের ধারণাটি বেশ পুরোনো। ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আর্থিক সরবরাহ ব্যবস্থার গতিপ্রকৃতি ঠিক রাখার জন্য মুদ্রানীতি দেয়। এ থেকে মুদ্রানীতির ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়।
বাংলাদেশের মুদ্রানীতিতে আগামী ছয় মাসের জন্য নেওয়া বেশ কিছু নীতির প্রতিফলন থাকে। পরের ছয় মাসে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য কত, তা মুদ্রানীতিতে ঘোষণা করা থাকে। এজন্য ওই সময়ে নীতি সুদের হার কত থাকবে, এর দিকনির্দেশনা থাকে। আবার সরকারি-বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কত হবে, তাও ঠিক করে দেওয়া হয়। থাকে সার্বিক পরিস্থিতি অনুসারে মুদ্রার সরবরাহ কেমন হবে, সেই দিকনির্দেশনাও। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে খোলাবাজার কার্যক্রম, সংবিধিবদ্ধ জমার অনুপাত পরিবর্তনসহ সুদহার পরিবর্তনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ তথা মুদ্রার সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেওয়া হয় মুদ্রানীতিতে। রিজার্ভ মানি বা টাকা ছাপানো হবে কি না, এর প্রতিফলন থাকে। সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মূল্যস্ফীতি। আয়ের সঙ্গে সংগতি না রেখে খরচ বেড়ে গেলে অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের কষ্ট বাড়ে। এজন্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। মানুষের অপ্রয়োজনীয় ভোগকে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আগের চেয়ে সুদের হার বাড়িয়ে ঋণের খরচ বাড়ানো হয়। এতে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হন। আমদানি খরচও বাড়ে। আবার বিলাস পণ্যে এলসি মার্জিন বাড়িয়েও পণ্য আমদানির রাশ টানা হয়।
বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এজন্য রাজস্বনীতির পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনার তদারকিও প্রয়োজন। সরকারের নেওয়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পণ্য ও সেবার চাহিদা ও জোগানের পুরোটা প্রতিফলিত হয় না। এরপরও রিজার্ভের পতন ঠেকানো স্বস্তির বিষয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বর্তমানে কিছুটা স্থিতিশীল। এতে আমদানির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা সময় লাগে। এখানে রাজস্বনীতি, বাজার তদারকিসহ অন্যান্য ব্যবস্থাও বেশ প্রাসঙ্গিক।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন