ফয়সাল আব্বাস
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১১:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির মোক্ষম সময়

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতির মোক্ষম সময়

ভূরাজনৈতিক গোলকধাঁধা এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার এক জটিল প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করার ব্যাপারটা আজ আর নিছক কোনো কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়। এটা বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর বিবেক, ন্যায়বোধ ও সাহসিকতার এক চূড়ান্ত পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আরেক দফায় ফিলিস্তিনের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর ওপর আবদ্ধ। এ বিপর্যয় রোধে যারা বিলম্ব করছে তাদের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, যারা প্রতিবাদ করার সাহস দেখাচ্ছে তাদের সমর্থন করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে একতরফা পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানোর আদর্শ সময় এখন। আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হলো ফিলিস্তিনকে অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, ইসরায়েল নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে যুক্তরাজ্যের সরকার অদূর ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এটা নিছক বিলম্বিত ন্যায়বিচারের এক বেদনাদায়ক নিদর্শন। যেই দেশ মধ্যপ্রাচ্যের এ ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে, তার পক্ষে এরকম বক্তব্য বিপর্যস্ত মানুষগুলোর জন্য নিতান্তই অপমানজনক। তবুও লন্ডন যদি শেষ নাগাদ তার ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের সাহস দেখায়, তবে সেটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে গণ্য হবে।

মধ্যপ্রাচ্যে অনেকগুলো পশ্চিমা রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। বর্তমানের এ জটিল পরিস্থিতি তৈরিতে যাদের হাত ছিল, তাদের মধ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্স—এ দুই প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আসন্ন সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি করেছে ফ্রান্স। তাদের সাহসী সিদ্ধান্তটা প্রশংসনীয় তো বটেই, একই সঙ্গে অনুকরণীয়ও।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেছেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মানেই হামাসকে পুরস্কৃত করা। এভাবে ভয়ের রাজনীতি করে যে তিনি এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন, সেটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। তার এ জাতীয় বক্তব্যগুলো একেবারেই প্রতারণামূলক। একদিকে তিনি জনসমক্ষে হামাসকে ঘৃণার প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন; অন্যদিকে তার নিজের সরকারই দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা অনুযায়ী গত ১৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে গোপনে এ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করে আসছে। বহুদিন ধরেই নথিবদ্ধ হয়ে আসছে নেতানিয়াহুর এই হামাস-পোষণের ছলচাতুরী। ৭ অক্টোবরের ভয়াবহ হামলার পর অনেক ইসরায়েলি গণমাধ্যমও এ ব্যাপারটায় আলোকপাত করে। দ্য টাইমস অব ইসরায়েল পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘বছরের পর বছর নেতানিয়াহু হামাসের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, এখন আমাদের তার খেসারত দিতে হচ্ছে।’ ২০১৯ সালে বিবি স্বয়ং বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দিতে চাইলে, হামাসকে শক্তিশালী করে তোলা উচিত।’

ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া আর সন্ত্রাসবাদকে বৈধতা দেওয়া এক কথা নয়। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো, সেসব লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে স্বীকৃতি দেওয়া, যারা যুগের পর যুগ রাষ্ট্রহীনতা, উচ্ছেদ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে, যারা যুদ্ধ, নৈরাজ্য ও দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি চায়, যাদের সঙ্গে হামাসের কোনো সম্পর্ক নেই। এ প্রস্তাব এমন এক শান্তির কাঠামো নির্মাণের প্রস্তাব, যেখানে ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি ইসরায়েলের নাগরিকরাও বহুল আকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এখন সময়ের দাবি। দুঃখজনক বিষয় হলো, ইসরায়েল নিজে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হয়েও তার বিধিনিষেধকে বরাবরের মতোই তাচ্ছিল্য করে যাচ্ছে।

নেতানিয়াহু ও তার চরম ডানপন্থি জোট চাইলেও এ কথা অস্বীকার করতে পারবে না যে, দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ পথ। ইসরায়েল যদি আঞ্চলিক স্বীকৃতি ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চায়, তবে এর কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী দুটি দেশ হলো ইরান আর সৌদি আরব। এদের মধ্যে ইরান তো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চায়ই, সৌদি আরবও বহুবার পরিষ্কার করে বলেছে, ইসরায়েল সৌদি সরকারের পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি চাইলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে হবে। আরব ও মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও কৌশলগত গুরুত্ব অত্যধিক। এর মধ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে ইসরায়েলি নেতৃত্বকে সমঝোতায় আসতে হবে।

দুঃখজনকভাবে, ইসরায়েলের বর্তমান ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর অনেকে আদর্শগতভাবেই শান্তিপূর্ণ সমাধানের ঘোরবিরোধী। যারা পশ্চিম তীর দখল করেছে, গাজাকে অবরুদ্ধ করেছে, ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, নির্দ্বিধায় সাধারণ মানুষ হত্যার নির্দেশ দিচ্ছে, যাদের নামে আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করাটা বেশ দুষ্কর। এদের রাজনৈতিক নীতিগুলো সহাবস্থানের জন্য নয়, বরং স্থায়ী সংঘাতের ভিত্তিতে ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত হয়। এদের কাছে যে কোনো ধরনের আপস, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করার আপসও বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল্য।

বিবিকে সমর্থন দানকারী ইসরায়েলি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বিন্দুমাত্র অনুশোচনা ছাড়াই গাজার সাধারণ মানুষকে ‘মানুষরূপী পশু’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পারমাণবিক হামলার ডাক দিয়েছে আর অধিকাংশই ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পক্ষে সরব থেকেছে। যখন নেতাদের এ ধরনের ভাষা সরকারি ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপান্তরিত হয় এবং জাতীয়তাবাদের মুখোশের আড়ালে নির্মমতা স্থান পায়, তখন রাষ্ট্রশাসনের নৈতিক দিকনির্দেশনাগুলো শুধু ভ্রষ্ট হয় না, একই সঙ্গে সেগুলো মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র হয়ে ওঠে।

এ কারণেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত ইতিহাসের ঔপনিবেশিক কলঙ্কমুক্ত দেশগুলোকে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে হবে। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে গ্রহণ করে একতরফাভাবে যারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত, তারা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব এবং ইউরোপে ফ্রান্সের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক জোট গঠন করে তাদের মতপ্রকাশ করতে পারে। অন্যথায় চরমপন্থিদের সঙ্গে আপস করার চেষ্টা কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমে সম্মিলিত মতের অপেক্ষা শুধু নিরুপায় ও অসহায় জনগণের কষ্টকে আরও দীর্ঘায়িত করতে থাকবে।

ফিলিস্তিনিদের মুক্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান প্রেক্ষাপটটা ইতিহাসের অন্য যে কোনো সময়ের সাপেক্ষে অনেক বেশি অনুকূল। হামাস ও হিজবুল্লাহ, দুটো সংগঠনই এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরান আশ্চর্যজনকভাবে নীরব হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মনোনিবেশ করেছেন ইউক্রেন-রাশিয়া, ভারত-পাকিস্তান, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার শান্তি আলোচনায়। অন্যদিকে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বাস্তববাদী ও রূপান্তরমুখী নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে নিজেকে জাহির করতে চাচ্ছেন। বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের মতো চটজলদি মধ্যপ্রাচ্যকে এক নতুন রূপে রূপান্তরিত করার সুবর্ণ সুযোগ এখনই। যুদ্ধের বদলে স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য, সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ওপর ভিত্তি করে এ অঞ্চলকে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব।

সব কথার শেষ কথা হলো, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া কোনো বিদ্রোহী আচরণ নয়। এটা বর্তমানে মানবিক মর্যাদা রক্ষার এক প্রতিশ্রুতিতে রূপ নিয়েছে। সাধারণ মানুষের কয়েক দশকের ভোগান্তির অবসানের আহ্বান এটি। এমন এক ভবিষ্যতের দিকে পদক্ষেপ নেওয়ার অপেক্ষায় আছে বিশ্বের সাধারণ জনগণ, যেখানে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা শুধু পাশাপাশি নয়, একই সঙ্গে সমান মর্যাদার সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এখন আর কোনো কূটনৈতিক বিষয় নয়, এটা গোটা বিশ্বের সামনে ন্যায়বিচার ও মানবিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিহাস কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদেরও আর অপেক্ষা করা উচিত নয়।

লেখক: আরব নিউজ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এবং সৌদি সাংবাদিক সংঘের সহসভাপতি। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নির্বাচন নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে : ব্যারিস্টার অসীম

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিহাস গড়ল সাইফের ‘গো বিয়ন্ড’

জুলাই সনদে মতামত দিল আরও ৩ দল 

গাজার পক্ষে থাকতে মেলানিয়া ট্রাম্পকে এরদোয়ানের স্ত্রীর চিঠি

পেটের মেদ কমাতে এই ৬টি খাবার বাদ দিন

কী কী চুক্তি-সমঝোতা স্মারক সই হলো বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে

শিশুকে ধর্ষণের দায়ে যুবকের যাবজ্জীবন

আফগানিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজ চূড়ান্ত, জেনে নিন কবে কখন ম্যাচ

মুখ খুললেন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী

ইরানে অভিযান, ইসরায়েলসংশ্লিষ্ট ছয়জন নিহত

১০

টানা বৃষ্টি কতদিন থাকবে, জানালেন আবহাওয়াবিদ

১১

স্থায়ীভাবে সিনেমা থেকে সরে দাঁড়াবেন জলিল-বর্ষা দম্পতি

১২

খোলা মাঠে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত বৃদ্ধ

১৩

যুদ্ধ বন্ধে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকা

১৪

যমুনা সেতুতে কাভার্ডভ্যান-ট্রাক-পিকআপের সংঘর্ষ

১৫

’৭১ সালের অমীমাংসিত বিষয় দুবার সমাধান হয়েছে, দাবি ইসহাক দারের

১৬

ক্রিকেটকে ‘গুডবাই’ বললেন একশর বেশি টেস্ট খেলা তারকা ক্রিকেটার

১৭

শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চালকদের বিশ্রামাগার নিজেই বিশ্রামে

১৮

সপ্তাহে দুদিন ছুটিসহ রূপায়ণ গ্রুপে চাকরির সুযোগ

১৯

পুরো শরীর ‘প্লাস্টিকের তৈরি’ বলায় খেপে গেলেন মৌনি

২০
X