প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের নাম ‘চাঁদের পাহাড়’। ১৯০৯ সালে ভারত থেকে ভাগ্যান্বেষণে আফ্রিকায় যাওয়া এক যুবকের দুঃসাহসিক অভিযাত্রার ঘটনা অবলম্বন করে রোমাঞ্চকর এ উপন্যাসটির কাহিনি। শংকর নামের সেই যুবক হীরার খনির সন্ধানে আফ্রিকার গহিন অরণ্য ও পাহাড়ের গুহায় প্রবেশের সময় ফেরার পথে যাতে পথ না হারায়, সেজন্য চিহ্ন রেখে যেত। অরণ্যে প্রবেশের সময় বৃক্ষের ডাল ভেঙে বা গায়ে চিহ্ন এঁকে আর পাহাড়ের গুহায় প্রবেশের সময় দুপাশের দেয়ালে খড়িমাটি দিয়ে তীরচিহ্ন এঁকে রেখে যেত, যাতে ফেরার পথ চিনতে ভুল না হয়। আসলে যে কোনো মানুষের সামনে এগোনোর সময় প্রয়োজনে পেছনে ফেরার পথ খোলা রাখা উচিত। তা ছাড়া কতটা পথ এগোলে নির্বিঘ্নে ফিরে আসা যাবে, সেটাও পথচলার শুরুতেই ভেবে নেওয়া উচিত। অনেক দিন আগের কথা। আমাদের এলাকায় এক গ্রাম্য মারপিটের ঘটনায় এক ব্যক্তি অপরিণামদর্শীর মতো লাঠি হাতে দৌড়ে প্রতিপক্ষের দিকে এতটাই এগিয়ে গিয়েছিল যে, সে আর ফিরে আসতে পারেনি। তিন দিক থেকে তিনটি বর্শা তার দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল। এজন্যই বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির এ সময়ে আমার শুধুই মনে হচ্ছে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুরন্তগতিতে এগিয়ে যাওয়ার সময় ফেরার পথের চিহ্ন দিয়ে যাননি। যে কারণে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে তিনি যখন এগিয়ে চলছিলেন, তখন তার ফেরার পথ যে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তা মোটেই খেয়াল করেননি। শেখ হাসিনা এ অপরিণামদর্শী পথচলার সঙ্গে কবি রফিক আজাদের ‘বালক ভুল করেছে পড়েছে ভুল বই’ কবিতার কিছু পঙক্তির সাজুয্য পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে/ ফেরার পথ নেই—থাকে না, নিরুপায়—/ যে আসে সে-ই জানে—ভুলের দামে কিনে/ আনে সে প্রিয় ম্যাপ—পথিক ম্রিয়মাণ,/ উল্টোরথে চ’ড়ে চলেছে মূল পথ!’ বাস্তবিক শেখ হাসিনা ক্ষমতার দম্ভে উল্টোরথেই চড়ে বসেছিলেন। সেই উল্টোরথ তাকে টেনে নিয়ে গেছে অপরিণামদর্শিতার শেষ গন্তব্য শোচনীয় পতনের দিকে।
আজ অনেকেই শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন। কেউ কেউ হাত খুলে লিখছেন। তার এ করুণ পরিণতি নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। এক বছর আগেও এটা কল্পনা করা যেত না। একজন ক্ষুদ্র লেখক ও টিভি আলোচক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। সেই সময় বেশ কয়েকটি পত্রিকা থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, সরকারের ‘মোলায়েম সমালোচনা’ করতে পারবেন, মন্ত্রীদেরও। তবে শেখ হাসিনাকে স্পর্শ করা যাবে না। টিভি টকশোতেও এমন সতর্কবার্তা প্রায়ই শুনতে হয়েছে। তারপরও মুখ ফসকে দু-চারটি কথা বেরিয়ে যাওয়ার কারণে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়েছি সেসব মিডিয়ায়। ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল’ ও সরকারের দাবিদার আওয়ামী লীগ ও তার প্রধান শেখ হাসিনা যে গণতন্ত্রের ন্যূনতম অনুশীলনেও বিশ্বাসী ছিলেন না, তা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিগড়ে বন্দি করার অভিপ্রায়ে তিনি বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে দুপায়ে দলেছিলেন। কথাবার্তায় ছিল হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ, দেশটাকে ভাবতেন পৈতৃক সম্পত্তি। জমিদারিও বলা যায়। সারা বিশ্বে যখন গণতন্ত্রের মৌসুম চলছে, তখন তিনি অবলম্বন করেছিলেন স্বৈরতন্ত্রের পথ। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা বা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ‘জমিদারি’ নয় যে সেখানে তিনি যা বলবেন, সবাইকে সেটাই মানতে হবে।
তবে হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত সবাই তার কথা মেনেছিল বা মানতে বাধ্য হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন সাবেক প্রেসিডেন্টের দুটি উক্তি প্রাসঙ্গিক মনে করছি। প্রথমটি দেশটির তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের। তার একটি উক্তি হলো—‘আপনার যা কিছু প্রয়োজন, একটি সরকার তা দিতে পারে। আবার আপনার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়ার জন্য একটি সরকারই যথেষ্ট।’ সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা এ দেশের মানুষকে কী দিয়েছেন, কী দিতে পারেননি, সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে তিনি যে এ দেশের মানুষের কাছ থেকে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতাসহ মৌলিক ও মানবাধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়। কয়েক বছর আগে, সম্ভবত ২০২০-২১ সালে, আওয়ামী লীগের সমর্থক এক ব্যবসায়ী কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, শেখ হাসিনা অনেক ভালো কাজ করছেন। কিন্তু দুটি কাজের জন্য তাকে ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হবে। এক. রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন মুসিবত ডেকে আনা। দুই. তিনি বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার ধ্বংস করে দিয়েছেন। ওই ভদ্রলোকের কথা যে সর্বাংশে সঠিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাষ্ট্রক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে শেখ হাসিনা হেন হীন পন্থা নেই, যা অবলম্বন করেননি। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও সেগুলোর নেতৃত্বকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের পেশিশক্তি দ্বারা নিশ্চিহ্ন করার এক ভয়ংকর খেলায় মেতেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের একটি বিখ্যাত উক্তি হলো—‘আপনি সব মানুষকে কিছু সময়ের জন বোকা বানাতে পারবেন এবং কিছু মানুষকে সবসময়ের জন্য বোকা বানাতে পারবেন। কিন্তু আপনি সব মানুষকে সবসময়ের জন্য বোকা বানাতে পারবেন না।’ বোধকরি শেখ হাসিনা এসব মনীষী-উক্তি বিস্মৃত হয়েছিলেন। অথবা ‘ওসব এখন অচল’ বলে একপাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি হয়তো জানতেন না, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হলেও ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর ছায়া পরবর্তী সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই পড়ে। রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের দ্বারা তিনি এ দেশের মানুষকে কিছুটা সময়ের জন্য একরকম বোধ ও বাকশক্তিহীন করে রাখতে পেরেছিলেন বটে। কিন্তু সময়ের গতিপ্রবাহের অনিবার্য পরিণতিতে তারা আর বাকরুদ্ধ হয়ে থাকেনি। সাড়ে পনেরো বছর বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা মানুষগুলো সুযোগ পেয়ে একযোগে নেমে এসেছিল রাজপথে। ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। তখন তাদের চিত্ত হয়েছিল ভয়শূন্য, শির হয়েছিল উঁচু। সেই উন্নত শিরকে আর অবনত করাতে পারেননি শেখ হাসিনা। যার ফলে শিক্ষার্থীদের একটি ছোট্ট আন্দোলনের শিখা দাবানলে পরিণত হয়ে তার গদিকে ছারখার করে দিয়েছে।
হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বারবার ব্যর্থতার সমালোচনা ছিল সবার মুখে মুখে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। সে সময় একাধিক টকশোয় আমি তাদের বলেছিলাম, একটি সামান্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ একটি নগরকে ভস্মীভূত করে দিতে পারে। আবার চৈত্রের প্রখর রোদে শুকিয়ে তাতিয়ে থাকা খড়ের গাদাকে ছাই করে দিতে একটি ছোট্ট দিয়াশলাইয়ের কাঠিই যথেষ্ট। ২০২৪-এ এসে তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে, তখন কেউ ভাবতেও পারেননি, আন্দোলনের ক্ষুদ্র প্রদীপটিই অল্প কয়েক দিন পরই দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা এবং তার সঙ্গী-স্যাঙাতরাও অনুধাবন করতে পারেননি, তাদের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে যাচ্ছে। তাই তারা সে আন্দোলন নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হাসিঠাট্টা করেছিলেন। আসলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা তখনো বুঝতে পারেননি, জনমত তাদের সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে গেছে। তারা এটা একেবারেই উপলব্ধি করতে পারেননি, দেশবাসীর মনের ক্ষোভ চৈত্রের রোদে শুকনো মচমচে খড়ের রূপ ধারণ করে বসে আছে। তারা পনেরো বছর যেভাবে পেশিশক্তি দিয়ে বিএনপির আন্দোলন দমন করে আসছিলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকেও সে একই কায়দায় দমন করবেন ভেবেছিলেন। তাই আন্দোলন দমাতে তারা গ্রেপ্তার, হত্যা ও গুমের আশ্রয় নিলেন। তারা ভেবে দেখেননি, জনগণ সরকারের এসব পদক্ষেপ কী চোখে দেখছে। তাই যখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গণআন্দোলনে রূপ নিল, তখন আর তা সামাল দিতে পারলেন না। পরিণতিতে ক্ষমতা হারিয়ে দেশছাড়া।
আপাতদৃষ্টিতে যে কারও মনে হওয়া স্বাভাবিক, বিএনপির পনেরো বছরের হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলন পুরোটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। বস্তুত তা সর্বাংশে সঠিক নয়। এটা ঠিক, বিএনপি তাদের সেসব আন্দোলন চূড়ান্ত সাফল্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তাদের কৌশল ও দলীয় সাংগঠনিক শক্তির দৌর্বল্যের কথা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বিএনপির সেসব আন্দোলন দেশবাসীর মধ্যে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাবিরোধী মনোভাবকে জনমতে পরিণত করার ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছিল। পাশাপাশি ওই সময়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের দুর্নীতি-লুটপাট জনমনে যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল, তা জনবিস্ফোরণ ঘটায়। একই সঙ্গে বিরোধীমত দমনে শেখ হাসিনার সরকারের ফ্যাসিবাদী কায়দা তাদের গ্রহণযোগ্যতার পারদকে নামিয়ে দিয়েছিল হিমাঙ্কের নিচে। জনসমর্থনশূন্য সেই সময়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হাসিনা সরকারের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছিল সহজেই।
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো স্বৈরশাসকই তাদের পতনের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পায় না। হাসিনা সরকারের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। তাই আমরা দেখেছি, ঘোরতর আন্দোলনের মুখে ১৭ জুলাই রেডিও-টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে তিনি যে ভাষণ দেন, তাতে মানুষ হত্যার জন্য না ছিল কোনো অনুশোচনা, না ছিল সংকট সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার জন্য সহায়তা কামনা। আসলে মানুষ যখন আত্মঅহমিকায় অন্ধ হয়ে যায়, ঔদ্ধত্য যখন চরমে ওঠে, তখন তারা বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারে না। ইরানের শাহান শাহ রেজা শাহ পাহলভি, ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোস, রোমানিয়ার নিকোলাই চসেস্কু, বাংলাদেশের এরশাদ—কেউই তাদের পতনের ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাননি। যখন শুনেছেন, তখন সময় অতিক্রান্ত। ক্ষমতার প্রাসাদ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর তাদের ছিল না। ঠিক তেমনি শেখ হাসিনাও তার পতনের ধ্বনি শুনতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা শুধু নয়, দেশত্যাগ করে তাকে জীবন বাঁচাতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার এ পরিণতি শুধু তার নয়, আগামীতে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবেন, তাদের জন্যও শিক্ষা। সামনে এগোনোর পাশাপাশি নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের পথটাও খোলা রাখা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন