

শহীদ শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। রোববার (২৮ ডিসেম্বর) দুপুর ২টা থেকে চট্টগ্রাম নগরের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নতুন ব্রিজ চত্বর মোড়ে অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এতে কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের একাধিক উপজেলা এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
দুপুরের পর থেকেই ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরা দলে দলে নতুন ব্রিজ চত্বরে জড়ো হতে থাকেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে এসে তারা কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর সংযোগ সড়কে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে কক্সবাজারগামী সড়কের প্রবেশমুখে বসে পড়ে অবরোধ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। এতে মুহূর্তের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের যান চলাচল। সড়কের দুই পাশে দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে পড়ে দূরপাল্লার বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল।
অবরোধ চলাকালে পুরো নতুন ব্রিজ চত্বর পরিণত হয় প্রতিবাদী জনসমুদ্রে। শহীদ শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকা। ‘বিচার বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই’, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমরা সবাই হাদি হব, যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘খুনি কারা, প্রশাসন জবাব দাও’এমন স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে সড়ক। অনেকের হাতে শহীদ হাদির ছবি, ব্যানার ও ফেস্টুন দেখা যায়।
কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর নতুন ব্রিজ চত্বর দক্ষিণ চট্টগ্রামের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত। এই সড়ক দিয়েই প্রতিদিন কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগড়া, চকরিয়া, চন্দনাইশসহ আশপাশের উপজেলা ও জেলার লক্ষাধিক মানুষ যাতায়াত করেন। ফলে অবরোধের কারণে পুরো দক্ষিণাঞ্চলে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সড়কে আটকে পড়ে পণ্যবাহী ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস। অনেক যাত্রী গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী ও দূরপাল্লার যাত্রীরা।
পটিয়াগামী যাত্রী শাকিল আহমেদ বলেন, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে আছি, কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। ভোগান্তি হচ্ছে ঠিকই, তবে একজন মানুষকে এভাবে হত্যা করে পার পেয়ে গেলে রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা থাকবে না। বিচার না হলে এমন আন্দোলন হওয়াটাও দরকার।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারী রাকিব বলেন, ‘ওসমান হাদি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সাহসী কণ্ঠ। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আজও যদি খুনিরা ধরা না পড়ে, তাহলে এই রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এটাই প্রমাণ হয়। তাই ন্যায়ের দাবিতে আমরা রাজপথে নেমেছি।’
আরেক আন্দোলনকারী ফাতেমা বলেন, ‘হাদি ভাইয়ের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে কেউ রাজনীতি করবে, আর আমরা চুপ করে থাকব এটা হতে পারে না। আমরা নারী হিসেবেও রাজপথে নেমেছি। কারণ ন্যায়বিচার শুধু রাজনীতির বিষয় নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের অধিকার।’
ইনকিলাব মঞ্চের নেতারা বলেন, ‘এই অবরোধ কোনো রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কর্মসূচি নয়। এটি শহীদ হাদির হত্যার বিচার আদায়ের আন্দোলন। অবিলম্বে খুনিদের গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না করলে আন্দোলন আরও কঠোর কর্মসূচিতে রূপ নেবে।’
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক রাফসান রাকিব বলেন, ‘শহীদ শরিফ ওসমান হাদির রক্তের দায় রাষ্ট্রকে নিতেই হবে। প্রশাসনের নীরবতা আমাদের হতাশ করেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি, কিন্তু আমাদের দাবি একটাই হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না।’
এর আগে শনিবার শহীদ হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ইনকিলাব মঞ্চ। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান নেন সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। সেখান থেকে আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখ হিসেবে পরিচিত শহীদ শরিফ ওসমান হাদি গত বছরের আগস্টে ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করেন। তিনি ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও আপসহীন। একই সঙ্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবেও তিনি রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় ছিলেন।
গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে পল্টন থানার বক্স কালভার্ট রোডে হামলার শিকার হন শরিফ ওসমান বিন হাদি।
মতিঝিল মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে প্রচারণা চালিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেলে আসা প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ রাহুল দাউদ ও তার অজ্ঞাত পরিচয় সহযোগী হাদিকে লক্ষ্য করে চলন্ত অবস্থায় গুলি চালায়।
গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ১৫ ডিসেম্বর তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় গত ১৪ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বাদী হয়ে পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, হত্যাচেষ্টা ও বিপজ্জনক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়।
মন্তব্য করুন