

বাংলাদেশে কোনো ফসলের রেকর্ড ফলন সাধারণত কৃষি খাতের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হলেও আলু চাষের ক্ষেত্রে এ বছর তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। চলতি বছর দেশে আলুর রেকর্ড উৎপাদন হলেও চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন আলুচাষীরা। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় হিমাগারগুলোতে গত মৌসুমের অবিক্রিত আলুর বিপুল মজুদ রয়ে গেছে। এর মধ্যেই আগাম আলু বাজারে আসায় সরবরাহ আরও বেড়েছে, ফলে আলুর দামে ব্যাপক ধস নেমেছে।
এই পরিস্থিতিতে একদিকে যেমন হিমাগারে সংরক্ষিত আলু বিক্রির জন্য ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে নতুন আলুর বাজারদর উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। এতে কৃষকদের লোকসান ক্রমেই বেড়ে চলছে এবং আলু চাষে টিকে থাকা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত মৌসুমে দেশে ১ দশমিক ১৫ কোটি টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মাত্র ৯০ লক্ষ টন। এই ২০ লাখ টনের বেশি উদ্বৃত্ত আলু পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিয়েছে।
রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সময় শেষ হয়েছে ৩০ নভেম্বর। অথচ তারপরেও থেকে গেছে বিপুল আলু।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী শাখার সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বলেন, ‘বাজারদর কোল্ড স্টোরেজ ভাড়ার চেয়েও কম হওয়ায় কৃষকরা আলু তুলতে আসছেন না।’
তার মতে, রাজশাহীর ৪৬টি হিমাগারের এখনও প্রায় ৬ লাখ বস্তা আলু মজুদ রয়েছে। বর্তমানে হিমাগারে শুকনা আলু ৫/৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, অথচ হিমাগারের ভাড়াই কেজি প্রতি ৬৭৫ টাকা।
এদিকে কৃষকরা আলু বের করতে না আসায় মজুদকৃত আলু নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন হিমাগারে মালিকরা। তারা ভাড়া বাবদ প্রায় ২৫ কোটি টাকা এবং ঋণসহ অন্যান্য খাতে আরো ২৫ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান জানান, এক বস্তা আলুর হিমাগার ভাড়া ৪৫০ টাকা হলেও বাজারে এক বস্তা আলুর দাম মাত্র ২০০ টাকা। লোকসানের ভয়ে অনেক কৃষক হিমাগার থেকে আলু তুলতেই যাচ্ছেন না। এই বিপুল লোকসান অনেক কৃষককে ব্যাংক ঋণ ও ক্ষুদ্রঋণের জালে জড়িয়ে ফেলেছে।
এদিকে হিমাগারগুলোতে গত মৌসুমের বিপুল আলু অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে থেকে পচছে, অন্যদিকে বাজারে নতুন আলুর দাম উৎপাদন খরচের অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। কৃষকরা জানান, সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বাজারে আগাম আলুর ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই এসময় ফলন কম ও উৎপাদন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে খরচ বেশি হলেও আগাম আলুর দাম চড়া থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে নতুন আগাম জাতের আলু প্রতি কেজি ১০-১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যেখানে কৃষকদের উৎপাদন খরচ পড়েছে কেজি প্রতি ২০-২৫ টাকা।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সার, সেচ ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার আগাম আলুর উৎপাদন খরচ গতবারের তুলনায় বেড়ে গেছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার কৃষক আব্দুল মালেক জানান, তিনি প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে প্রায় ২২ টাকা খরচ করলেও তা মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের মতে, হিমাগারের পুরনো আলুর আধিক্যের কারণে বাজারে নতুন আলুর দরপতন হয়েছে।
রংপুর ও নীলফামারী জেলায় পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। সেখানে আলুর দাম এতোটাই কমেছে প্রতি কেজি আলু ৭-১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে অনেক চাষী আলুকে গরুর খাবার (পশুখাদ্য) হিসেবে ব্যবহার করছেন।
চাষিদের অভিযোগ, আলু ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ কেবল কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। গত আগস্টে সরকার হিমাগার পর্যায়ে আলুর সর্বনিম্ন মূল্য প্রতি কেজি ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় নি। এছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের ৫০ হাজার টন আলু সংগ্রহের পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি। রপ্তানির ক্ষেত্রে মানসম্মত কোল্ড-চেইন লজিস্টিকসের অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কৃষকদের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইলিয়াস হোসেন বলেন, চাষিদের অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে, তারা অনেক যত্ন করে ফসল ফলিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেই ফসলের বাজারমূল্য এখন হিমাগারের ভাড়ার চেয়েও কম; অনেকটা ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, এভাবে লোকসান হতে থাকলে আগামী মৌসুমে কৃষকরা আলু চাষ কমিয়ে দিতে পারেন, যার ফলে ভবিষ্যতে বাজারে আলুর তীব্র সংকট এবং দামের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। যা দেশের কৃষি অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
মন্তব্য করুন