ফিলিস্তিনের গাজা ও আশপাশের এলাকায় দুর্ভিক্ষ চলছে। অনাহারী মানুষের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে ওই অঞ্চলের বাতাস। দিনের পর দিন না খেয়ে আছে ওই এলাকার শিশুরা। তাদের দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। হাড় জিরজিরে ওই শিশুদের দিকে তাকালে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গড়িয়ে পড়ে অশ্রুজল। তবুও বিশ্ববিবেক এখন নীরব। মধ্যপ্রাচ্যের দেশের নেতারা তো বটেই, পাশ্চাত্যের মানবতার ফেরিওয়ালাদেরও চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। সবার বিবেক যেন অনুভূতিহীন, মানবিক বোধ যেন দেউলিয়া হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনের অনাহারী অসহায় মানুষদের প্রশ্নে সবাই যেন চেতনাহীন স্থবির। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে গৃহযুদ্ধপীড়িত আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদানে আমরা এমন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছি। সত্তরের দশকে আমাদের দেশেও হানা দিয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন ও লুটপাটের কারণে সৃষ্ট ওই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল দশ লক্ষাধিক মানুষ। তবে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এখানে পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক বিরল মর্মান্তিক ঘটনা।
গাজা উপত্যকার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। শুক্রবার জাতিসংঘ সমর্থিত দ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী মাসের শেষ নাগাদ গাজা উপত্যকার মধ্যভাগের প্রশাসনিক অঞ্চল দেইর আল-বালাহ এবং দক্ষিণের খান ইউনিসেও দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ লাখ ৪১ হাজার গাজাবাসী দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বেন। গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গাজা উপত্যকা মোট পাঁচটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এর মধ্যে উল্লিখিত তিনটি অঞ্চলের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে আইপিসি; কিন্তু ইসরায়েলের সেনাদের কড়াকড়ির কারণে উপত্যকার সর্বউত্তরের প্রশাসনিক অঞ্চল নর্থ গাজার তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি আইপিসি। আর সর্বদক্ষিণের রাফা অঞ্চল মোটাদাগে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় সেখানকার তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি।
আইপিসি খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করে। তারা এ কাজের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ২০১১ সালে সোমালিয়ায়, ২০১৭ ও ২০২০ সালে দক্ষিণ সুদানে এবং ২০২৪ সালে সুদানে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত করে। অর্থাৎ আফ্রিকার বাইরে গাজা নগরে এবারই প্রথমবারের মতো দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত করেছে আইপিসি।
চলতি বছরের মার্চের শুরুর দিকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে ইসরায়েল। এতে খাবার, ওষুধ ও জ্বালানির তীব্র ঘাটতি দেখা দেয়। মে মাসের শেষের দিকে সীমিত পরিমাণে সহায়তা পৌঁছানোর অনুমতি দেওয়া হলেও ঘাটতি থেকে গেছে।
সম্প্রতি গাজা নগর সম্পূর্ণ দখলের অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। প্রায় দুই বছরের যুদ্ধে ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের গাজা উপত্যকার প্রায় ৭৫ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করেছে ইসরায়েল। গাজা নগর দখলের মধ্য দিয়ে তা প্রায় ৮৫ শতাংশে দাঁড়াবে। গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে ৬২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মাধ্যমে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিল ইহুদিরা। সেই ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, তা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে। ইতিহাস থেকে তারা কোনো শিক্ষা নেয়নি। বিশ্বমানবতা তাদের এই নির্মমতা নীরবে সহ্য করলেও ইতিহাস তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
মন্তব্য করুন