ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি হবে না, তা এখন আর বাংলাদেশের বিষয় নয়। বিশ্বের অনেকের চোখ এ নির্বাচনের দিকে। অথচ নির্বাচন নিয়ে সংশয়-সন্দেহ কেটে গেছে দেশের প্রধান দল বিএনপিরও। দলটি এখন বলছে, নির্বাচনে বিএনপির বিজয় ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। এ চেষ্টা চলাই স্বাভাবিক। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জানিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবিলা করবেন। সেটাই হওয়া উচিত।
তারেক রহমানের কষ্ট ভিন্ন জায়গায়। তার ভাষায়—আশ্চর্যের বিষয়, স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে এবার সরকার নয়; বরং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের সহযোদ্ধা, কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, গোষ্ঠীর আচরণও পলাতক স্বৈরাচারের সরকারের মতো। বিএনপির বিজয় ঠেকাও। আমরা খেয়াল করছি, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বক্তব্য, মন্তব্য বা নিত্যনতুন শর্ত সামগ্রিকভাবে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে, জনগণ বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে পারে। এই ভয়ে পলাতক স্বৈরাচার বিএনপির বিজয় ঠেকাওর মতো অন্তর্ঘাতী অপরাজনীতি চালু করেছিল। এরা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাও গত ১৬-১৭ বছরে ধ্বংস করে দিয়েছিল। বর্তমানে ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে নির্বাচন দিলে জনগণ ভোট দিয়ে বিএনপিকে সরকার গঠনে সহায়তা করবে বলে বিশ্বাস তার।
তারেক রহমানের কথা ও কষ্টের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার, নির্বাচন নিয়ে সংশয় কেটে গিছে। এজেন্ডা এখন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া বনাম বিএনপি ঠেকাও। এই ঠেকাও মোকাবিলায় পাল্টা ঠেক অবশ্যই দেবে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তখন কোথায় থাকবেন, কী করবেন—এ প্রশ্নের জবাবও মিলে গেছে। তা জানিয়েছেন স্বয়ং তিনিই। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসারাট নিউজে নিবন্ধ লিখে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। নতুন সরকারে কোনো পদেই আমি থাকছি না।’ নিবন্ধটিতে গত বছর বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান, অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত নিবন্ধে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন শেষেই তিনি রাষ্ট্রের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন।
ড. ইউনূসের নিবন্ধটির চৌম্বক অংশের কয়েকটি লাইন এমন—এক বছর আগে, এই মাসেই বাংলাদেশের হাজার হাজার সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিক্ষার্থী, যাদের পেছনে ছিল সমাজের সর্বস্তরের অগণিত মানুষের সমর্থন, আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, যা শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল, তার মাধ্যমেই তারা একজন স্বৈরাচারকে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এরপর যে ক্ষমতার শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ছাত্রনেতারা আমাকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানায়। ...এই সরকারের দায়িত্ব ছিল দেশকে স্থিতিশীল করা এবং গণতন্ত্রের নতুন পথ তৈরি করা। শুরুতে আমি রাজি হইনি। কিন্তু যখন তারা জোর করল, তখন আমি তরুণদের জীবন উৎসর্গের কথা ভাবলাম, আমি তাদের ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে আমি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করি।
...এই গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা থেকে। এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম ‘জেনারেশন জেড’ বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এই বিপ্লব তরুণদের জন্য একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে, যা দেখায় কীভাবে তারা মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো—যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বৈষম্য মোকাবিলার জন্য এগিয়ে আসতে পারে। ...আমরা ভাগ্যবান যে, তারা ‘তাদের পালা আসার জন্য’ অপেক্ষা করেনি। যখন সভ্যতা অনেক দিক থেকে ভুল পথে চালিত হচ্ছে, তখন তারা বুঝতে পেরেছিল যে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়। আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল গণঅভ্যুত্থানে যারা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল এবং যারা গুরুতর আহত হয়েছিল, সেই হাজার হাজার পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা। এর সঙ্গে আমরা বিগত সরকার ও তার সহযোগীদের লুট করা অর্থ উদ্ধারেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।
...ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার বছরে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছে। এই অর্থ পুনরুদ্ধার করার জন্য যুদ্ধ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ...যখন আমি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন অব্যবস্থার মাত্রা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছিল না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছিল। সরকারি কর্মচারীরা, যারা ক্ষমতাসীন দলের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য না দেখানোর কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তারা ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন।
...ধীরে ধীরে আমরা পুনর্গঠন শুরু করেছি। যেসব রাজনৈতিক দল স্বৈরাচারের প্রতিরোধ করেছিল, তাদের পাশাপাশি নতুন গঠিত দলগুলোও নতুন ধারণা, শক্তি এবং কর্মপ্রচেষ্টা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সশস্ত্র বাহিনী, যারা ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীদের ওপর গণহত্যা চালাতে দেয়নি, তারা তাদের পেশাদারিত্ব বজায় রেখেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। ...আমি এটি স্পষ্ট করে দিয়েছি, আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমি এর পরের সরকারের কোনো নির্বাচিত বা নিযুক্ত পদে থাকব না।
নতুন সরকার আসার পর তিনি কী করবেন, কোথায় থাকবেন—এ দুটি বিষয় ছাড়া বলার তো আর কিছু অবশিষ্ট রাখেননি ড. ইউনূস। সেটা অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরই এক জায়গায় বলেছেন, তিনি আবার তার আগের সোশ্যাল বিজনেসের কলিগদের কাছে ফিরে যাবেন। নির্বাচন ও ড. ইউনূস সম্পর্কে এমন স্পষ্ট তথ্যের পরও প্রশ্ন কিন্তু থামছে না। নির্বাচন আসলে কি হবে?—প্রশ্নটি রাজনীতির পিছু ছাড়ছে না। সরকারের দিক থেকে জবাব দেওয়া হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। এমন কোনো শক্তি নেই যে নির্বাচন বিলম্বিত করতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন, সে অনুযায়ী নির্বাচন হবে।’
এরপরও কেন প্রশ্নের ঘোরতোর? শহর-বন্দর-জনপদে মানুষের মুখে মুখে এ প্রশ্ন। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় তো কথামালার ধুম। শব্দবোমা নিক্ষেপ। ড. ইউনূসের নিবন্ধকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। বলার চেষ্টা হচ্ছে, তিনি ছাড়বেন না, থেকে যেতেই এত কথা বলছেন। আর কী করলে বা বললে বিশ্বাস করানো যাবে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন এবং নির্বাচনের পর আর তিনি থাকছেন না? ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলেও তা সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ হবে কি না, এ প্রশ্নও ঘুরছে। প্রশ্নটির মধ্য দিয়ে নির্বাচন হবে না—এ নেরেটিভটি অন্তত কেটে গেছে বলা যায়। তারপরও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী মন্তব্য-সমালোচনায় সংশয় জিইয়ে থাকছে। উত্তেজনার পারদও চড়ছে। সংশয়-সন্দেহ প্রকাশ করা দলগুলোও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। ক্ষেত্রবিশেষে কারও কারও প্রস্তুতি নির্বাচনের জন্য উতলা বিএনপির চেয়েও বেশি। তা শহর-গ্রাম সবখানেই। সবকিছু ঠিক থাকলে এবার ভোট উৎসবমুখর হবে এমন একটা লক্ষণ ঘুরছে। ৫ আগস্টের পর রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজের নানা চালচিত্রের মধ্যেও এর নমুনা বিদ্যমান। সমাজে জেগে ওঠা শক্তিগুলোও সামর্থ্য জানান দিতে শুরু করেছে। বিভিন্ন সেক্টরে ফ্যাসিবাদী আমলের গডফাদার-ধড়িবাজরা পালিয়ে যাওয়ায় তারা সুদিন দেখছে। এই দিনকে সেই দিনের কাছে টেনে নেওয়ার লক্ষণও কম নয়। দখল-দূষণ এবং সুশাসনের প্রশ্নে শক্তিমান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক বয়ানে, আচরণে, কর্মদক্ষতার প্রয়াসে বড় কোনো পরিবর্তনের আভাস দেখা দিয়েছে, এ বিশ্বাসে ভর করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে এই পুরোনো রাজনৈতিক চর্চাই যে বহুল পরিমাণে ফিরবে না, জনগণকে পুরোনো দিনের দুঃশাসন উপহার দেবে না—সেই বিশ্বাস দেওয়ার পাটাতন সবলভাবে দৃশ্যমান নয়।
রাজনীতির এ সংস্কৃতি এবার ভোটের ব্যালটে বিপুলভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো সতর্ক ও হিসাবি না হলে, পুরোনো হিসাব ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। গত বছর ৫ আগস্টের আগে ফ্যাসিবাদী হাসিনার যে হিসাব সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছিল জেনজি, এবার ভোটেও সেরকম পুরোনো ভাবনাকে উল্টে যেতে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন ভোটারদের ‘ভোটচিন্তা’ নয়া আকারে হাজির হতে পারে। জেনজি-জেনারেশনের সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভরতা, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ক্ষতস্মৃতি, শক্তিমান রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পেশিবহুল আচরণ আমাদের শক্তিমান রাজনৈতিক দলগুলোর পুরোনো ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে দারুণভাবে। পুরোনো বা বয়সী ভোটারদের নন-পার্টিজান, সৎভাবাপন্ন দায়িত্বশীল অংশের মধ্যেও একটা গুণগত পরিবর্তন হতে পারে। ফ্যাসিবাদী দলের বিচারের প্রশ্নে, ইসলামোফোবিয়ার প্রশ্নে, প্রগতিশীলতার প্রশ্নে, ভারতের প্রশ্নে, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ‘বুভুক্ষা-মডেলে’র প্রশ্নে তাদের অবস্থানেও নৈর্ব্যক্তিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। ইতিবাচক পরিবর্তন সবারই কাম্য। তাই আগামীতে কারা আসছেন ক্ষমতায়?
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তন মাথায় রেখে কি সম্ভাব্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠবে—এ জিজ্ঞাসা বেশি বেশি থাকা উচিত। ‘দেবত্ব’ জাহির করা সংস্কৃতির ইতি পড়বে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের হওয়ার কথা জনগণের পক্ষে ক্ষমতার হেফাজতকারী। রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিসভা ও আমলাদের হওয়ার কথা জনসেবা প্রদানের খাদেম। নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী বা এমনকি পরাজিত দলও ভালোভাবে সংসদ-সরকার পরিচালনা ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির স্বার্থে নেতাদের মধ্য থেকে এবং দলীয় নীতি ও মতাদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যোগ্য ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রকাশ করতে পারে। মন্ত্রী বা ছায়ামন্ত্রীর ধারণা এখনই প্রকাশ করলে আরও ভালো। নতুনত্ব দেখবে মানুষ। তা ভরসা না হলেও কিছু আগ্রহ জাগাবে। কারণ, সময়ে সময়ে আশাবাদী হতে হতে মানুষ আশা ‘বাদই’ দিয়েছে। রাজনীতিবিদদের বুলি আওড়ানোর দিন ‘বাঘে খেয়েছে’ এবং নতুন প্রজন্ম সামনেও অনেক কিছু করে ফেলবে—সেই গ্যারান্টি এখনো নেই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন