ভিউ আর ভাইরালের ভার্চুয়াল জগতে তিনি আর নেই। একবুক জ্বালা নিয়েই যেন ওপারে চলে গেলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নীতিবান সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। ধারণা করা যায়, স্বেচ্ছায় তার এ মরণযাত্রা। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম গত শুক্রবার রাতে টেলিভিশনের পর্দায় তার মৃতদেহ মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদী থেকে উদ্ধারের সংবাদ দেখার পর থেকেই। উত্তর মিলল গতকাল সকালে কালবেলা পত্রিকার চার নম্বর পাতায় প্রকাশিত বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ লেখা বা চিঠির মধ্যে।
ব্যক্তিজীবনে আমি সেনাবাহিনী, জাতিসংঘ, মধ্যপ্রাচ্য ও দেশের করপোরেট জগতে চাকরি করছি প্রায় ৪০ বছর। লেখালেখি আমার শখ, নেশা ও আনন্দ উপভোগের মাধ্যম। এ সূত্রে আমার পরিচয় বিভুরঞ্জন সরকারের সঙ্গে। ডাকতাম বিভুদা নামে। খুব আন্তরিক ছিল তার প্রতিক্রিয়া। চাকরি জীবনে নিজ নাম প্রকাশ করে লেখার ক্ষেত্রে নানামুখী সংকট ছিল। সেনাবাহিনীতে একসময় শুধু সেনাসদস্যই নয়, তাদের স্ত্রী বা সন্তানদের লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রেও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের অনুমতি লাগত। শিক্ষা পরিদপ্তর দেখত লেখার গুণগত মান আর গোয়েন্দা পরিদপ্তর দেখত বিতর্কিত কিছু ছিল কি না। মজার ব্যাপার হলো, বৃষ্টি কিংবা নদী নিয়ে লেখা ছড়া বা কবিতা প্রকাশের জন্যও ছাড়পত্র লাগত। আর অভিনয়ের অনুমতি পাওয়া ছিল আরও কঠিন বিষয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কেউ হয়তো গবেষণা করেছেন কিংবা থিসিস করেছেন। কিন্তু যিনি আদৌ কোনোদিন গবেষণা করেননি বা কোনো ধরনের উচ্চতর লেখাপড়া করেননি, তাকেই দিতে হতো সেই গবেষণাপত্রের ছাড়পত্র। ঠিক ওই সময়টায় ছদ্মনাম ব্যবহার করে লেখা পাঠাতাম বিভুদার পত্রিকায়। প্রায়ই ছাপা হতো সেই লেখাগুলো। কর্মস্থল পরিবর্তন করে তিনি বিভিন্ন প্রকাশনায় কাজ করেছেন। আমিও হেঁটেছি তার পিছু পিছু। কারণ সেনাবাহিনীর চাকরি হারানোর ভয়ে আমি নিত্যনতুন ছদ্মনামে লিখতাম। কিন্তু লেখাগুলো প্রকাশ হতো দেখে বুঝতাম নিশ্চয়ই বিভুদা পত্রিকা অফিসে আসা সব লেখা পড়তেন এবং প্রকাশযোগ্য হলে তা প্রকাশ করতেন। যা কিছু আজ লিখতে শিখেছি বা লিখছি তার নেপথ্যে ছিল সেদিনের লেখা ছাপানোর উৎসাহ এবং তার নেপথ্য নায়ক বিভুদা।
আজ অনেকেই পত্রিকায় লেখা ছাপাতে কী করতে হবে জিজ্ঞেস করলেই বলি, পত্রিকার অফিসে পাঠাতে থাকো, নিশ্চয়ই একদিন না একদিন ছাপা হবে। কারণ আমার বিশ্বাস ছিল, প্রতিটি পত্রিকা অফিসে অন্তত একজন করে বিভুদা আছেন, যারা আগে লেখাটা পড়েন এবং তারপর লেখকের নাম দেখেন। আর নাম যাই হোক, প্রকাশের যোগ্য হলে তা প্রকাশ করেন।তবে বিভুদার শেষ চিঠি পড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে উপলব্ধি করলাম—আমার ধারণা ভুল। কারণ, বিভুদার লেখাও নাকি ‘পাঠক আর সেভাবে খায় না’। বিভুদার আক্ষেপ, ‘আজ আমার লেখা নাকি পাঠক টানে না’। তার সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তার সঙ্গে কথা বলতেন না। তাহলে নতুন লেখকদের লেখা কে পড়বে? কে ছাপাবে?
নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক ও মঞ্চব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদের আবিষ্কার ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কথাটি বারবার মনে পড়ে।একবার বিভুদার সঙ্গে আমার সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে। টকশোর আগে, পরে ও বিরতিতে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও গণমাধ্যমের উত্থানপতনের অনন্য সাক্ষী তথা এনসাইক্লোপিডিয়া মনে হয়েছে তাকে। তবে টেলিভিশনের পর্দায় তার বিরল উপস্থিতি কেন—এমন প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম অন্য এক টকশোতে অংশ নেওয়ার সময়। সেখানে উপস্থাপক ছাড়াও সহ-আলোচক হিসেবে পাশে ছিলেন একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। জ্ঞানগর্ভ কথা হচ্ছিল। এরই মধ্যে প্রথম বিরতিতে সেদিন টকশো পরিচালনা ও প্রযোজনা গ্রুপের একজন এসে জানালেন, সরাসরি প্রচারিত এই চলমান টকশোর ভিউ, লাইক কিংবা শেয়ার সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছেনি। সুতরাং এমন কিছু বলতে হবে, যেন দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে ইউটিউব ও ফেসবুকে তা ভাইরাল হয়। ভিউ, ভাইরাল আর লাইকের জগতে তাই বিভুদারা এভাবেই মনের কষ্টে ভোগেন এবং হতাশ হয়ে স্বেচ্ছায় লেখার অভ্যাস, সৃষ্টির নেশা, এমনকি জীবনের মায়াও ত্যাগ করেন।
নানা কারণে গণমাধ্যমের বহুজনের সঙ্গে আমার সখ্য। তাদের অনেকের মতে, গণমাধ্যম আজ বোবাকান্নার আজব জগতে পরিণত হয়েছে। মফস্বলের গণমাধ্যমকর্মীর অধিকাংশ কোনো বেতন বা আর্থিক সুবিধা পান না। গণমাধ্যমের লোগো লাগানো বুম, মাউথপিস বা মাইক্রোফোন ব্যবহার এবং ভিজিটিং কার্ড ছাপানোর অনুমতি দিয়েই তাদের প্রতি বড় দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে করে ঢাকাভিত্তিক বহু গণমাধ্যমের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। তাহলে মফস্বলের গণমাধ্যমকর্মীরা কীভাবে সংসার চালান? এমন প্রশ্নের উত্তর সবার জানা, কিন্তু প্রকাশযোগ্য নয়। মফস্বলের গণমাধ্যমকর্মীরা অন্য কোনো পেশা থেকে আয় করেন এবং এর পাশাপাশি সাংবাদিকতা করেন—এমনটাই দেখা যায়।তবে যখন তারা ঠিকাদারি বা সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেন কিংবা অফিস-আদালতে তদবির বাণিজ্য করতে গণমাধ্যমের লোগো লাগানো বুম, মাউথপিস, মাইক্রোফোন বা ভিজিটিং কার্ড সরকারি অফিসের কর্তাদের টেবিলে রেখে কথা শুরু করেন, তখনই বাধে যত বিপত্তি। মফস্বলে ক্রাইম রিপোর্টার হওয়ার প্রতি আগ্রহ বেশি থাকার পেছনেও অনেক কারণ আছে বলে ধারণা করা হয়। সবাই সবকিছু জানে, বুঝে, কিন্তু সমাধানের জন্য এগিয়ে আসছে না কেউ।
ঢাকার গণমাধ্যমগুলোর অফিসেও বোবাকান্না বহমান বলে গুঞ্জন শুনতে পাই। বিশেষত জাঁদরেল ও সুন্দরী গণমাধ্যম নেতানেত্রীর ইশারায় ঢাকাস্থ গণমাধ্যমকর্মীদের চলতে হতো বিগত দিনগুলোয়। এসব নেতানেত্রীর মধ্যে অনেকেই আজ পলাতক, জেলে আটক এবং মামলার জালে বন্দি।অনেকের দেশ-বিদেশে বহু ধন-সম্পদের বিবরণ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে অনেক গণমাধ্যমের কর্মীরাই নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না বলে খোদ মিডিয়াপাড়ায় কান পাতলেই শোনা যায়। সারা দেশের মানুষের বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাদের লেখা ও তাদের নির্মিত সংবাদ ভাইরাল হলে ইউটিউব ও ফেসবুকের কল্যাণে মালিকপক্ষের কত আয় হয়, তা তারা জানেও না। তারা শুধু জানে বকেয়া বেতন বা ভাতা হয়তো সামনের অত তারিখে পাওয়া যাবে। আবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের খবর প্রচার করা গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেরাও যে বৈষম্যের শিকার, তা প্রকাশ করার সাহস নেই অনেকের। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় নিউজ প্রেজেন্টাররা অনেক ক্ষেত্রেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনঃকষ্টে ভোগেন সংবাদ সম্পাদনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল প্রতিবেদন প্রকাশ করার সংস্কৃতি। এসব প্রতিবেদন কাঙ্ক্ষিত দর্শক দেখলে, পছন্দ করলে বা শেয়ার করলে ফেসবুক এবং ইউটিউব থেকে টাকা পান গণমাধ্যমের মালিকরা। তাই এসব ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির সঙ্গে যারা যুক্ত, মালিকপক্ষের কাছে তাদের কদর থাকে বেশি। আর যারা নিষ্ঠার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ প্রকৃত সংবাদ আঁকড়ে ধরে আছেন, তারাই নিমজ্জিত হন হতাশায়। তাই তো একজন বিভাগীয় প্রধানকে যে বেতন দেওয়া হতো, বিভুদা পেতেন তার অর্ধেক।
বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও মাফিয়াতন্ত্র গ্রাস করেছে দেশের মেধাভিত্তিক জগতকে। দুটি বই লিখেও বিভুদা কোনো টাকা পাননি বলে শেষ চিঠিতে লিখে গেছেন। অথচ বইমেলায় প্রতি বছর নিত্যনতুন তথাকথিত ভাইরাল লেখক ও তারকাশিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। নির্দিষ্ট স্টলে তাদের উপস্থিতির কারণে আশপাশের সব স্টলের সামনেও মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সেই ভাইরাল লেখক ও শিল্পীকে দেখতে ও সেলফি তুলতে। বইমেলা আসার আগেই পাণ্ডুলিপি চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন এক শ্রেণির প্রকাশক। টাকা দিলেই প্রকাশিত হয় টাকাওয়ালার বই। অথচ পৃথিবীব্যাপী প্রকাশকরা একটি মান বজায় রাখার জন্য সম্পাদনা রীতি ও মান যাচাই রীতি অনুসরণ করেন। তবে বাংলাদেশে বহু বিভুদা মানসম্মত বই লিখেও প্রকাশক খুঁজে পান না। কারণ, পাঠকরা সেই বই ‘খায় না’। আরেক শ্রেণির প্রকাশক খোঁজেন সরকারি কর্তাব্যক্তি ও তাদের স্ত্রীদের। কারণ, এমন কর্তা বা তার স্ত্রীর বই প্রকাশ করলে সরকারিভাবে তা কেনা হবে, এটা নিশ্চিত। বিগত দিনে এক কর্তাব্যক্তির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বই কেনা হয়েছিল সরকারি টাকায়। তিনি এমনই লেখক যে, তার নামও আজ আর মনে পড়ছে না। অন্যদিকে প্রকাশকরা দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে সরকারিভাবে ক্রয় তালিকায় নিজেদের প্রকাশিত বইয়ের নাম ঢুকিয়ে লাভবান হন। অথচ বিভুদার মতো লেখকরা সকালে উঠেই ভোগেন ওষুধ কেনার চিন্তায়।
এক সময় দুর্দান্ত সব নাটক বানাতেন আমার খুব কাছের এক বন্ধু। ইদানীং ঠিকাদারিতে মন দিয়েছেন। তিনি কোনো তথাকথিত ভাইরাল নায়ক-নায়িকার কথা মাথায় নিয়ে লিখতে জানেন না। তার কলমে অশ্লীল সংলাপ বের হয় না। তিনি চরিত্র দেখে শিল্পী খুঁজতেন, চেহারা বা স্পন্সরদের পছন্দ দেখে নয়। তিনি নাটক বানিয়ে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বা স্পন্সরদের খুশি করার জন্য বাড়তি কিছু করার বিপক্ষে ছিলেন। তাই এ জগৎও তার বিপক্ষে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। বিনোদন উপকরণের প্রযুক্তিগত মান, বৈচিত্র্যও বাড়িয়েছে। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে ভিউ ও ভাইরালের ভিড়ে একজন বিভুদার এভাবে চলে যাওয়া কোনো ভালো লক্ষণ নয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক ধরনের গণমাধ্যমকর্মী নিপীড়নের শিকার হবেন আর আরেক দল বাড়তি সুবিধা পাবেন—এ সংস্কৃতির অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক। ওপারে ভালো থাকুক প্রিয় বিভুদা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন