হানি হাজাইমাহ
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ০৮:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গাজা পুনর্দখল নেতানিয়াহুর চরম ভ্রম

গাজা পুনর্দখল নেতানিয়াহুর চরম ভ্রম

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড শুধু গাজাকেই নয়, একই সঙ্গে ইসরায়েলকে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে এবং আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার ভঙ্গুর কাঠামোকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে মোটেই বিচলিত হচ্ছেন না তিনি, উল্টো আবারও আগুন নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন। ইসরায়েলের এ প্রধানমন্ত্রী একের পর এক বেপরোয়া পরিকল্পনা করে যাচ্ছেন। গাজাকে পুনর্দখল করার অভিসন্ধি প্রকাশ করেছেন তিনি। তার এ অভিপ্রায় শুধু স্বল্পদৃষ্টিসম্পন্ন নয়; একই সঙ্গে এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অপরাধমূলক এবং এর পরিণতি ভয়াবহ। বিবির এ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত আছে এমন এক ঔদ্ধত্য, যা ইতিহাসকেই নিজের ইচ্ছেমতো পাল্টে দেওয়ার এক ভ্রান্ত বিশ্বাসে উজ্জীবিত।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে বলা দরকার। সেটা হলো, গাজা পুনর্দখলের পরিকল্পনাটি না ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, না আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। এ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে কয়েকটি বিষয় কেন্দ্র করে সাজানো, সেগুলো হলোÑনেতানিয়াহুর ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা, দুর্নীতির মামলাগুলোর জবাবদিহি এড়ানো এবং বিশৃঙ্খলা, ব্যর্থতা ও রক্তক্ষয়ী নেতৃত্বের মধ্য দিয়েও নিজেকে ইসরায়েলি জনগণের কাছে শক্তিশালী শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা। রাজনৈতিক মঞ্চে তার টিকে থাকার খেলায় গাজা আরও একবার দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহৃত হচ্ছে।

ইসরায়েলি ট্যাঙ্কগুলো আবার গাজায় প্রবেশ করলে ইসরায়েল নিরাপদ হয়ে উঠবে—এমন ভ্রান্ত ধারণা বিক্রি করছেন নেতানিয়াহু। অথচ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে, জোরপূর্বক দখল বরাবরই প্রতিরোধের জন্ম দেয়। দশকের পর দশক ধরে গাজাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রাখার ফলে এ অঞ্চলে এমন কিছু নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যারা নির্যাতনের কোনো শেষ দেখতে পায়নি, যারা মানুষ হিসেবে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারেনি, এমনকি শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধের মধ্যে জীবনের কোনো অর্থও খুঁজে পায়নি। এ প্রজন্মগুলোর জন্য জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যই হবে দখলদার শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

নেতানিয়াহু কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে গাজাকে পুনর্দখল করে, বিশ লাখ মানুষের গলায় দড়ি পরিয়ে, সেই দড়ি টেনে ধরে তিনি তাদের প্রতিরোধের ইচ্ছাকে দমন করতে পারবেন? তিনি এমনটা বিশ্বাস করে থাকলে মানতে হবে যে, তার চিন্তাধারায় বেশ ত্রুটি আছে। কারণ তিনি এমন এক ভয়াবহ অগ্নিঝড়ের সূচনা করতে যাচ্ছেন, যা হবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক তীব্রতর। ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করতে পারে, কিন্তু নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে না। দখলদারের অপরাধ যতই নির্মম হয়, তাদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ততই গভীর হয়, সংকল্প ততই অটল হয়, সংঘাত ততই দীর্ঘায়িত হয়।

ক্ষুধার্ত শিশুদের লাশ আর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া পরিবারগুলোর কবরের ওপর যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তা নিরাপত্তা নয়; বরং সেটা প্রতিরক্ষার ছদ্মবেশে গড়ে তোলা বর্বরতা। নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার সবচেয়ে জঘন্য দিক হলো, ফিলিস্তিনি জনগণের মানবিক বেদনাকে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অস্ত্রে পরিণত করছেন। গাজা বহু আগেই দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ পরিকল্পিতভাবে আটকে রাখা হচ্ছে, শিশুরা হাড়জিরজিরে হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, অসংখ্য মহল্লা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ এখনো নেতানিয়াহু ‘গাজা ব্যবস্থাপনা’ করার কথা বলেন, মানুষকে গবাদি পশুর মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চান তিনি।

এই গাজা ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনাটা মূলত অবৈধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ক্ষুধা, বাস্তুচ্যুতি ও হতাশা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে একটা জাতিকে দমন করার প্রক্রিয়া মাত্র। এটি এমন এক সমষ্টিগত শাস্তি, যা যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞার প্রতিটি শর্তের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। নেতানিয়াহু তার পরিকল্পনাকে স্থিতিশীলতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু এটা কার স্থিতিশীলতা? নিশ্চয়ই গাজার নয়। এমনকি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলেরও নয়। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার নামে তিনি শুধু নিজের ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন।

তবে এ বিপর্যয়ের কারণগুলো শুধু নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা বা আরও ভয়ংকরভাবে, তাদের সহযোগিতাও এ বর্তমান অবস্থা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে একদিকে সংযমের কথা বলা হয়, অন্যদিকে ইসরায়েলকে বোমা-বারুদ ক্রয় করার জন্য অর্থ সরবরাহ করা হয়। আর ইউরোপ আজও নিজেদের অপরাধবোধে জর্জরিত। তাই একদিকে তারা দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বুলি আওড়ায়, অন্যদিকে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধকে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করে। ইসরায়েল নিজেকে শক্তিশালী ভাবতে পারে, কিন্তু কোনো সেনাবাহিনী কখনোই লাখ লাখ মানুষের সম্মিলিত হতাশা ও ক্ষোভের ঢেউকে ঠেকাতে পারে না, তা সে যতই উন্নত আর শক্তিশালী হোক না কেন।

নেতানিয়াহু কোনো শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা উপস্থাপন করছেন না; তিনি সবার সামনে এক দুঃস্বপ্ন হাজির করছেন। তিনি গাজাকে উন্মুক্ত আকাশের নিচে এক কারাগারে পরিণত করতে চান। এ কারাগারে সরাসরি ইসরায়েলি সেনারা পাহারা দেবে; সেখানে কোনো স্বায়ত্তশাসন থাকবে না, তার টিকে থাকাটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করবে ইসরায়েলের ইচ্ছার ওপর। নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অপমান ও হতাশার জীবনে নিক্ষেপ করে আসছেন। আর সেটা করতে গিয়ে তিনি নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরায়েলিরা নিজেরাও যেন কখনো শান্তিতে থাকতে না পারে। কারণ, দমনপীড়নের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই শুধু শান্তি নিশ্চিত করা যায়। সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, দখলদারদের ট্যাঙ্কের কামান থেকে কখনোই ন্যায়বিচার প্রস্ফুটিত হয় না।

বিবির এ ষড়যন্ত্রকে সফল হতে দেওয়া চলবে না। গাজা পুনর্দখল শুধু নৈতিকতার অবক্ষয় নয়, এটা একই সঙ্গে কৌশলগত বিপর্যয়, যা অন্তহীন সংঘাত চলমান রাখবে। পশ্চিমা বিশ্বে যারা মানবাধিকারের পতাকা ওড়ায়, তাদের পক্ষে এখন করণীয় হলো, ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা এবং ইসরায়েলকে পাঠানো সাহায্যের ওপর শর্ত আরোপ করা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলকে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করানো এবং যেই সরকার মানবতার প্রতিটি নীতিকে পদদলিত করছে, সেই সরকারের প্রতি সমর্থন বন্ধ করাও তাদের দায়িত্ব।

এখন ইসরায়েলের জনগণের প্রতি প্রশ্ন হলো, আর কতদিন তারা একজন মানুষের বিভ্রমের কারণে তাদের জাতিকে চিরস্থায়ী যুদ্ধে আবদ্ধ করে রাখতে দেবে? তারা কি এখনো বুঝতে পারছে না যে, নেতানিয়াহু তাদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করছেন না, শুধু তার নিজের রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছেন? পুরোদমে যুদ্ধ চললে ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি রক্ত ঝরবে ইসরায়েলি নাগরিকদের। সেই রক্তের দাগ লেগে থাকবে নেতানিয়াহুর হাতে।

যারা নেতানিয়াহুকে তার মর্জি অনুযায়ী অত্যাচার চালিয়ে যেতে দিয়েছে, ইতিহাস তাদেরও ভুলে যাবে না। গাজা নিয়ে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা শুধু একটি নীতি নয়; এটি চিরস্থায়ী যুদ্ধের ঘোষণা। একটা সমগ্র জাতির শ্বাসরোধ করে তাদের বিলুপ্ত করার চেষ্টা এটি। এই বাজি ব্যর্থ হবেই। ফিলিস্তিনিদের মনোবল চূর্ণ করার চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে, ভবিষ্যতেও ব্যর্থ হবে। কিন্তু এ ব্যর্থতার মাশুল শুধু তিনি একাই দেবেন না। এর মাশুল দিতে হবে গাজার ক্ষুধার্ত শিশুদের থেকে শুরু করে ইসরায়েলের শোকাহত পরিবারগুলো পর্যন্ত সবাইকে। মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা বহুকাল যাবৎ বিপর্যয়ের কিনারায় ঝুলছে। নেতানিয়াহু যদি এমন আচরণ করতে থাকেন, তবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের এ অস্থিতিশীলতা।

এটাই হিসাব চুকানোর সময়। নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক, আইনি ও নৈতিক বিভ্রমকে স্পষ্ট, সাহসী ও অটল চিত্তের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্ববাসীদের এখন দুটো পরিণতির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে—হয় গাজাকে আবারও দখল হয়ে যেতে দিতে হবে, নয়তো দৃঢ়ভাবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনীতির ইতি টানতে হবে। তাকে এটা জানান দিতে হবে, ‘যথেষ্ট হয়েছে। ন্যায়বিচার, শান্তি ও আমাদের যৌথ মানবতার স্বার্থে এবার থামুন।’ ভবিষ্যতে গাজা পুনর্দখল হলে সেটা আঞ্চলিক বিস্ফোরণের স্ফুলিঙ্গ হয়ে রয়ে যাবে।

লেখক: জর্ডানভিত্তিক সাংবাদিক ও আরব নিউজ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সম্পাদক। নিবন্ধটি আরব নিউজ পত্রিকার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রদ্রিগোর বিস্ফোরক মন্তব্যে রিয়াল মাদ্রিদে ঝড়!

মার্কিন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে এই শরিফুল?

চট্টগ্রাম বন্দরে ‘স্টোররেন্ট’ এক মাসের জন্য স্থগিত

ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়া ইউটিউব ভিডিও দেখবেন যেভাবে

বাংলাদেশ-চায়না আপন মিডিয়া ক্লাব ও টিএমজিবির মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই

অনিল কাপুরের সঙ্গে শয্যা দৃশ্য, ক্যামেরার সামনেই চিৎকার ঐশ্বরিয়ার

শ্বশুরবাড়িতে আগুন দিয়ে পালালেন জামাই

সিলেটে মানববন্ধনের ঘোষণা দিয়ে স্থগিত করল এনসিপি

রুমিন ফারহানা ইস্যুতে এনসিপির সংবাদ সম্মেলন

হঠাৎ ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছাড়ছে মার্কিন বাহিনী

১০

‘এই অভিযোগ আমি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করছি’

১১

জর্জিনার আংটিতে লুকিয়ে রোনালদোর প্রেমবার্তা!

১২

বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের দাম দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ

১৩

এনবিআইইউ প্রক্টর বরখাস্ত

১৪

ভোক্তা অধিকার রক্ষায় অংশীজনের সমন্বিত ভূমিকা শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

১৫

আবারও ১১ বাংলাদেশিকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি

১৬

আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি দিচ্ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

১৭

ফজলুর রহমানের পক্ষে মি‌ছিল, ‌স্লোগা‌নে উত্তাল অষ্টগ্রাম

১৮

ডাকসুর ভিপি-জিএস পদে কার ব্যালট নম্বর কত

১৯

পোষ্য টাইসনকে মৃত অবস্থায় পেলেন নিলয় আলমগীর

২০
X