অধিকার মানুষের জন্মগত। প্রত্যেক মানুষ অধিকার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। মানুষ মর্যাদাপূর্ণ জীবন ধারণ করতে চায়, যা সম্ভব ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এতে দেশের সব শ্রেণির নাগরিক সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবনযাপন করতে পারে। একটি রাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক নাগরিকের সক্ষমতা, অবস্থা ও অবস্থান এক নয়। শারীরিক অক্ষমতা, প্রান্তিকতা, অনগ্রসরতা, ভৌগোলিক অবস্থান, দারিদ্র্য, বিপন্নতা, সামাজিক অবক্ষয়সহ বিবিধ কারণে অনেক মানুষ অধিকারবঞ্চিত। রাষ্ট্র জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই বঞ্চিত জনতা প্রয়োজনে রাষ্ট্রের কাছে অধিকার নিয়ে হাজির হয়। ‘অধিকার’ হচ্ছে জনগণের ন্যায্য পাওনা, যা আইন ও বিধিবিধান দ্বারা স্বীকৃত। মানুষের মৌলিক প্রাপ্যতায় দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকার। ‘মানবাধিকার’ হচ্ছে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা, সহজাত ক্ষমতার সৃজনশীল বিকাশ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের ব্যবস্থা।
প্রতিবন্ধীরা সমাজে অনগ্রসর ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তারা অবজ্ঞা কিংবা বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধীসহ সব নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে। তা ছাড়া সংবিধানের ১৭, ২০ ও ২৯ অনুচ্ছেদে বাধ্যতামূলক শিক্ষা, ন্যায্য পারিশ্রমিক ও কর্মে নিযুক্তিতে সুযোগের সমতা বিধানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬১তম সভায় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ’ (United Nations Convention on the Rights of the Persons with Disabilities) বিশ্বব্যাপী একটি মানবাধিকার সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। ৩ মে ২০০৮-এ সনদটি একটি আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে বলবৎ হয় এবং বাংলাদেশে এ সনদে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী অন্যতম রাষ্ট্র। এ সনদের ২৪ নম্বর ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির শিক্ষার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ সনদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে মানুষ হিসেবে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি প্রতিভা, মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী পূর্ণমাত্রায় বিকাশের সুযোগ লাভ করে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা দেশের নাগরিক। সম্পদের সুষম বণ্টন ও সুযোগের সমতা প্রাপ্তি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার। এ লক্ষ্যে সরকার ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ প্রবর্তন করে। এ আইনের ২(৯) ধারায় ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতা কী, তা সুস্পষ্ট করা হয়েছে। ‘প্রতিবন্ধিতা’ হচ্ছে যে কোনো কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোনো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত প্রতিকূলতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব। যার কারণে ওই ব্যক্তি সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণমাত্রায় অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। এ আইনের ৩ নম্বর ধারায় ১১ ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ধরন উল্লেখ আছে। দেশের সর্বশেষ প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ মতে মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৩৬.৪৬ লাখ। প্রবর্তিত আইনের ১৫ নম্বর ধারায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রাপ্য অধিকারগুলোর বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা—পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা, সমান আইনি স্বীকৃতি, উত্তরাধিকার প্রাপ্তি, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, সব স্তরে শিক্ষার সুযোগ, কর্মে নিযুক্তি, প্রতিবন্ধিতার শিকার ও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি, নিপীড়ন হতে সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, কর্মক্ষেত্রে উপযোগী পরিবেশ, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন, সাংস্কৃতিক চর্চা, ক্রীড়া ও বিনোদনের সুযোগ ইত্যাদি। স্নায়বিক বিকাশজনিত প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তিদের জীবন অনেক চ্যালেঞ্জিং। তাদের সুরক্ষার জন্য সরকার প্রবর্তন করেছে ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩’। এ আইনের মূল উদ্দেশ্য স্নায়বিক বিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনি সুরক্ষা প্রদান করা। এ আইনের আওতায় একটি ট্রাস্ট পরিচালিত হচ্ছে। এ ট্রাস্টের মূল লক্ষ্য: যথাসম্ভব স্নায়বিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। উপযোগী শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞানের ব্যবস্থা করা এবং সামাজিকভাবে ক্ষমতায়ন করা।
বৈচিত্র্যময় মানবজীবন। মাতৃগর্ভ থেকে জন্মের মাধ্যমে মানবজীবনের সূচনা। প্রতিটি পরিবারের প্রত্যাশা সুষ্ঠু ও সুন্দর শিশুর জন্মগ্রহণ। কিন্তু কিছু কিছু শিশু পূর্ণ ও স্বাভাবিক সক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারছে না। অনেক মানবশিশু জন্মগ্রহণ করছে শারীরিক অক্ষমতা কিংবা মানসিক অক্ষমতা নিয়ে। এরা সমাজে প্রতিবন্ধী হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা জন্মগত ত্রুটি বা জন্ম জটিলতার শিকার। গর্ভকালীন পরিচর্যার ঘাটতি, অপচিকিৎসা, পুষ্টিহীনতা, রোগব্যাধি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অন্তঃসত্ত্বাদের প্রতি অবহেলাসহ বিবিধ কারণে মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে সমাজে জন্মগ্রহণ করে। আবার অনেক মানুষ জন্ম-পরবর্তী দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজে অবহেলিত, অবজ্ঞা ও বৈষম্যের শিকার হয়। মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সর্বক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও দেশের নাগরিক। সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নাগরিক হিসেবে প্রতিবন্ধীসহ প্রত্যেকের মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার অধিকার রয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে শিক্ষা উপবৃত্তি ছাড়াও বিবিধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। যার মধ্যে অন্যতম—প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পুনর্বাসনে ক্ষুদ্রঋণ, বাক-শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমসহ ইত্যাদি। এ কার্যক্রমগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সম্পদের সুষম বণ্টন সুনিশ্চিত করা। শিক্ষা হচ্ছে মানব মূলধন সৃষ্টির অন্যতম উপাদান। এটি সামাজিক বিনিয়োগেরও অন্যতম ক্ষেত্র। টেকসই উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সমাজের সব পক্ষের সার্থক অংশগ্রহণ আবশ্যক। পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ শিক্ষা অপরিহার্য। ‘প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি’ কর্মসূচি হোক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে এক অনন্য মাইলফলক। বৈষম্য নয়। প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হোক সমাজের ব্রত।
লেখক: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, ঢাকা
মন্তব্য করুন