চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বিভুরঞ্জন সরকার। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যের বিবর্ণ রূপ বহু উদাহরণে স্পষ্ট করেছেন তিনি। ২২ আগস্ট মেঘনার পানি থেকে পুলিশ যখন তার লাশ উদ্ধারে ব্যস্ত, কাছাকাছি সময়ই ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে তার জীবনের শেষ লেখা। পঞ্চাশ বছর সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক লেখাটি একটি অনলাইন পোর্টালকে মেইল করেছিলেন ২১ আগস্ট সকাল ৯টায়। ফুটনোটে উল্লেখ করেছেন ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন’। ওইদিন সকাল ১০টা থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। পরদিনই মেলে তার ভাসমান লাশ। ২৩ আগস্ট লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। মৃতদেহে শরীরী আঘাতের কোনো চিহ্ন ময়নাতদন্তকারীরা খুঁজে পায়নি। তবে হৃদয় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার বহু চিহ্নই বিভুরঞ্জন স্পষ্ট করে গিয়েছেন তার সর্বশেষ লেখায়।
পরিবর্তিত বাংলাদেশে সংবাদপত্র-সাংবাদিকরা এখনো যে প্রভাবশালীদের ‘চোটপাট’ আর ‘লাল চোখের’ মুখোমুখি, বিভুরঞ্জন লিখেছেন সে কথা। পাশাপাশি পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক দীনতাসহ রাজনৈতিক ট্যাগে একজন সংবাদকর্মীর জীবন কতটা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে, দীর্ঘ লেখায় ছিল সেসব বিষয়ও। শুধু দলকানা-দলদাস সাংবাদিকতা করলেই যে আর্থিক প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব নয়, এজন্য যে ভিন্ন যোগ্যতারও প্রয়োজন পড়ে—লেখায় ছিল সেই ইঙ্গিতও। আর্থিক দীনতায় জীবন অনিশ্চিত পথে হাঁটলে, পেশাগত জীবনে অমর্যাদাকর পরিস্থিতি তৈরি হলে বৃদ্ধ বয়সে একজন সাংবাদিক কোন পথে হাঁটতে পারেন, আপাতত বিভুরঞ্জন সরকার তার সর্বশেষ উদাহরণ।
এর আগের উদাহরণ ছিলেন আশির দশকের সাড়াজাগানো প্রথিতযশা সাংবাদিক মিনার মাহমুদ। ২০১২ সালের ২৮ মার্চ স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালে প্রথাবিরোধী সাংবাদিক হিসেবে অনন্য উচ্চতায় স্থান হয়েছিল তার। সাপ্তাহিক বিচিন্তা সম্পাদক হিসেবে তিনি হয়েছিলেন আলোচিতদের একজন। বিচিন্তাতে লিখেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন আজকের দিনের অনেক বড় লেখক ও সাংবাদিক। কিন্তু সেই বিচিন্তা সম্পাদকই শেষ জীবনে হয়ে পড়েন সর্বহারা। নিজেকে নিঃশেষ করার আগের রাতে লেখা একটি চিঠিতে মিনার মাহমুদ লিখেছিলেন—“আমি সর্বহারা। ‘কিছু নেই’ একজন মানুষ। বিচিন্তা আবার প্রকাশ করেছিলাম, পাঠকরা নেয়নি। পরে একটি চাকরির জন্য কত চেনা-অচেনা পত্রিকা মিডিয়ায় চেষ্টা করেছি, কেউ নেয়নি। হাজিরা দেব, নিয়মিত লিখব, মাস শেষে একটা বেতন কোথাও হয়নি। কাউকে অভিযোগ করিনি।” অভিযোগ ছাড়াই দুঃখ নিয়ে নিজের জীবন শেষ করেছেন মিনার মাহমুদ। কিন্তু জীবন আর সাংবাদিকতার প্রতি অনেক-অনেক অভিযোগ আর প্রশ্নের জন্ম দিয়ে অভিন্ন পথে হেঁটেছেন বিভুরঞ্জন।
প্রথিতযশা সাংবাদিক মিনার মাহমুদ ও বিভুরঞ্জন সরকার আত্মহননে নিজেদের জীবনযন্ত্রণা মিটিয়েছেন। কিন্তু জীবনযন্ত্রণাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েই মৃতপ্রায় প্রাণীর মতোই এখনো বেঁচে আছেন অসংখ্য বিভুরঞ্জন, অসংখ্য মিনার। স্ত্রী-সন্তান আর পরিবারের দায় এড়াতে না পেরে সাংবাদিকতার মতো চরম ঝুঁকিপূর্ণ অনিরাপদ পেশার মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছেন তারা। তাদের কারও চাকরি আছে, কারও নেই। এসব কলমযোদ্ধা গণমানুষের জীবনযুদ্ধের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন নিখুঁত লেখায়; কিন্তু তাদের জীবনযুদ্ধের গল্পগুলো থেকে যায় অপ্রকাশিত। শুধু মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহকর্মীদের স্মৃতিকথন ও কাগুজে সমবেদনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে সান্ত্বনা। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব মৃত্যু এড়াতে রাষ্ট্র, সমাজ, সংবাদপত্রের মালিক কিংবা সাংবাদিক সংগঠনের কোট-টাইধারী নেতাদের সত্যিকারের কার্যকর উদ্যোগ কখনো দৃশ্যমান হয়, কখনো হয় না।
পেশাদার সাংবাদিকদের এই যে পরিণতি, এর দায় শেষ পর্যন্ত নিতে চায় না কেউই। সবাই ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। সবার ব্যস্ততার মাঝেই হারিয়ে যায় এ দেশের প্রথিতযশারা। হারিয়ে যায় দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমকারী গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু কেন? এই কেনর ন্যূনতম সত্যিটা প্রকাশ করার মতো সংবাদপত্র কিংবা সম্পাদকের সংখ্যাও এ দেশে এখন নিতান্তই কম। কারণ আছে অবশ্যই। নিজের থুতু আকাশে ছুড়লে যেমন নিজের গায়েই এসে পড়ে, তেমনি সাংবাদিকদের করুণদশার নেপথ্যের সত্যগুলো উন্মোচিত হলে অভিযুক্তদের তালিকায় সবার আগে এসে যায় পেশাদার-অপেশাদার কিছু সম্পাদক ও ক্ষেত্রবিশেষ কিছু গণমাধ্যমের মালিকের নাম।
এ কথা এখন কারোই অজানা নয়, গত দশ-পনেরো বছর ধরে এ দেশে বড় বড় শিল্পগ্রুপ এবং নব্য শিল্পপতিদের কেউ কেউ গণমাধ্যম ব্যবসায় জোর দিয়েছেন। অলাভজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা জেনেও প্রতিষ্ঠা করেছেন টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজপোর্টাল। দুই-চারজন উদ্যোক্তাকে বাদ দিলে বাকি উদ্যোক্তাদের বড় অংশই গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঢাল হিসেবে। রুটি-রুজির প্রয়োজনে ওইসব গণমাধ্যমে ঢাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছেন পেশাদার সম্পাদক-সংবাদকর্মীরাও। ভাষার সীমাবদ্ধতা ভুলে গেলে বলতে হয়, কোনো-কোনো গণমাধ্যম আজকাল মালিকপক্ষের পোষা কুকুরের চেহারা ধারণ করে আছে। উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনে পেশাদার সংবাদকর্মীদের মাথার ওপর বসিয়ে দিচ্ছেন সম্পূর্ণ অপেশাদার অন্য পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। জীবনে এক দিনের জন্যও গণমাধ্যমের বারান্দায় যাদের পা পড়েনি, তারাই হয়ে যান সম্পাদক, হয়ে যান সর্বোচ্চ কর্তা। আর হাতচুম্বন করার জন্য অতিলোভী কিছু পেশাদার সংবাদকর্মীকেও পাশে পেয়ে যান তারা। চুম্বনে-চুম্বনে ও স্বার্থের আশকারায় পরবর্তীকালে ওইসব কর্তাই হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য স্বৈরাচারী। সংবাদকর্মীর মনের ভাষা পড়তে না পারায় তৈরি হয় মনের সংঘাত। স্বার্থের চুন সামান্য খসে পড়লেই সংবাদকর্মীদের ওপর বিরূপ হন তারা, নিয়মের তোয়াক্কা না করে এক সেকেন্ডেই করে দেন চাকরিচ্যুত।
আর এসব ঘটনা নীরবেই সহ্য করেন বেশিরভাগ সংবাদকর্মী। কেউ কেউ অবশ্য প্রতিবাদের চেষ্টা করেন, আশ্রয় খোঁজেন সাংবাদিক ইউনিয়নসহ অন্যসব সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের কাছে। অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিক নেতারা সামান্য বিবৃতিতেই দায় সারেন। কেউ কেউ অবশ্য আন্তরিকভাবে চেষ্টাও করেন। কিন্তু ফল ঘরে আসে না। ফল আসবে কী করে, সাংবাদিক নেতারাও যে ক্ষেত্রবিশেষ বড়ই অসহায়! তাদেরও যে পরিবার-পরিজন আছে। এমন অনেক সাংবাদিক নেতা এখনো আছেন, যারা অনেক মাস ধরে বেকারত্বের কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছেন। সারা জীবন ওয়েজবোর্ডের জন্য গলা ফুলিয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেছেন, ওয়েজবোর্ড পেতে সংবাদপত্রকে সনদ দিতে সহায়তা করেছেন, কিন্তু নিজেরা কোনোদিন ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন পাননি—এমন সাংবাদিক নেতাও আছেন অগণিত। অবশ্য কোনো কোনো সাংবাদিক নেতা অনেক অনেক প্রভাবশালী এবং ধনবানও বটে। যদিও সেটা শুধু সাংবাদিক নেতা হওয়ার কারণে নয়, বড় কারণ তাদের মাথার ওপর ছায়া আছে, বড় বড় রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য আশীর্বাদ আছে। তাদের কথায় কাজও হয়, কিছু সংবাদকর্মীর কর্মসংস্থান হয়, কেউ চাকরি ফিরে পান আবার কেউ ফিরে পান বকেয়া বেতনও। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওইসব প্রভাবশালী সাংবাদিক নেতা দলীয় আদর্শের অনুসারী না হলে মুখ খুলতে চান না। অনেকে আবার মালিকপক্ষের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় জড়িয়ে পড়েন। ফল হয় যেটা, উপেক্ষিতই থাকে সংবাদকর্মীর স্বার্থ। মাসের পর মাস বেতন না পেয়েও আশায়-আশায় চাকরি করেই যান অনেক অসহায় সংবাদকর্মী। আর্থিক দীনতায় কষ্টে কাটে তার জীবন, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের স্ত্রী-সন্তানের জীবনও।
অবধারিতভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, একজন সংবাদকর্মীর দুঃখ-দুর্দশার জন্য কি শুধুই অশুদ্ধ মালিক, অনুগত সম্পাদক, দলদাস-দলকানা সাংবাদিক ও ‘কিছু অসহায়’ সাংবাদিক নেতাদেরই দায়। আর কারও কি দায় নেই? আন্তরিকভাবে সংবাদকর্মীর স্বার্থরক্ষা করেন এমন মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতা কি নেই? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে অবশ্যই আছে, তবে সংখ্যায় নগণ্য। আর আছে বলেই এখনো পুরোপুরি মরে যায়নি সাংবাদিকতা, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি অনেক অনেক সংবাদকর্মীর সততা।
সংবাদকর্মীদের করুণ পরিণতির জন্য আর দায় আছে কার কার, সেই প্রশ্নের উত্তরটা একটু বিপজ্জনকই বটে। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের একতরফা শাসনকালে এ দেশের গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক ও সংবাদকর্মীরা প্রত্যক্ষ করেছেন রাষ্ট্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ। সত্য সংবাদ প্রকাশে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তাদের চাপে অনেক মালিক-সম্পাদককে ছাঁটাই করতে হয়েছে অতিপ্রিয় অনেক সংবাদকর্মীকে। অনেক সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছেন। কথা না শুনলে মালিকপক্ষের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত করার নজিরও আছে ভূরিভূরি। পরিবর্তিত বাংলাদেশে এখন কি চাপে নেই গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক ও সংবাদকর্মীরা। প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অসুবিধা হলেও সত্যিটা হচ্ছে, চাপ এখনো আছে। তবে কিছুটা কমেছে বৈকি।
মৃত্যুর আগের লেখায় আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকার যদি সত্যিই লিখে থাকেন, তাহলে বলতে হবে মালিক, সম্পাদক ও সংবাদকর্মীদের এখনো অনেক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে হচ্ছে। বিভুরঞ্জন সরকার শেষ লেখায় লিখেছিলেন, ‘সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করেছেন। আমি এখন কী করি, কোন পথে হাঁটি।’
বিভুরঞ্জন মৃত্যুকে বরণ করে নিজের পথে হেঁটে গিয়েছেন। আর শত দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যেও যেসব সংবাদকর্মী জীবনকে এখনো বড় বেশি ভালোবাসেন, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার-পরিজনের দায় এড়ানোর দুঃসাহস দেখাতে পারেন না, কোন পথে হাঁটছেন তারা। উত্তর বলে দেবে সময়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন