বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের চিকিৎসাসেবায় একটি আস্থার প্রতীক ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস)’। প্রতিষ্ঠিত বাডাস নামমাত্র মূল্যে ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসাসেবা প্রদানে গণমানুষের ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ডায়াবেটিসের আধুনিক চিকিৎসাসেবা ও গবেষণায় বাডাস দেশের সর্বত্র এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান। জনকল্যাণের মহান ব্রত নিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাডাস। যার হাত ধরে আজকের স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল, তিনিও একজন মহান পুরুষ। জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) প্রতিষ্ঠাতা; একই সঙ্গে ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের একজন পথিকৃৎ।
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তের পথে। প্রয়াণের দিনে তার প্রতি আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। মূলত, ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মৃত্যুর দিনেও ডায়াবেটিস চিকিৎসাসেবা বন্ধ করা হয়নি; এজন্যই তার মৃত্যু দিবসকে ‘সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ডায়াবেটিস সচেতনতায় আরও দুটি দিবস পালন করা হয়, যেখানে তাকে স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধাভরে। অবধারিতভাবে প্রতি দিবসের আলোচনায় তিনিই হয়ে ওঠেন সবার মধ্যমণি। তিনি তার কাজের যে ছাপ রেখে গেছেন, তা অনুসরণ করেই সফলতার শিখরে আরোহণ করছেন জ্ঞানী, গুণীরা।
নীরব মহামারি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মানুষকে সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিকে (৬ সেপ্টেম্বর) ‘ডায়াবেটিক সেবা দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অবদান চিরস্মরণীয়। মহান সেই ব্যক্তির আদর্শ ও চিকিৎসাসেবায় প্রয়োগ পদ্ধতির মূল কথা হলো—রোগীর সমস্যা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারলে রোগীর আস্থা বাড়বে, চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তি মানসিক শান্তি পাবেন, চিকিৎসক পরোপকারের সামাজিক স্বীকৃতি পাবেন এবং এর দ্বারা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উভয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় ও উপলক্ষ তৈরি হবে। দেশে অজস্র চিকিৎসক তার সেই নীতি অনুসরণ করেন। তাকে ‘রোল মডেল’ মেনে পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৪ সালে ড. ইব্রাহিম জাতীয় অধ্যাপক হন এবং দেশে তিনিই প্রথম চিকিৎসাবিদ, যিনি এ মর্যাদা পেয়েছিলেন।
ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের একটি বিরাট গুণ হলো—মানুষকে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন এবং তাদের দিয়ে কাজ আদায় করে নিতেন। দারুণ ও অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি ছিল তার। ডায়াবেটিক সমিতির সার্বিক কার্যক্রম দেখলেই সেটা অনুমান করা যায়। বিশাল প্রতিষ্ঠান বারডেম হাসপাতাল গড়ার পেছনে ডা. ইব্রাহিম স্যারের নিরলস প্রচেষ্টা, আন্তরিক ইচ্ছা এবং রোগীদের জন্য অকৃত্রিম মমত্ববোধ ও দরদি মন বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কিছু একটা করতে পারলেই তিনি যেন আনন্দ পেতেন। কর্মচারী-কর্মকর্তাকে যেমন বকাঝকা দিয়েছেন, শাসনও করেছেন, তেমনি আদর দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছেন। আজকাল এ দুইয়ের মিশ্রণে দুর্লভ গুণাগুণ খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আসলে এ রকম মহৎ গুণাবলিসম্পন্ন মানুষের সান্নিধ্যে আসাটাও কিন্তু চরম সৌভাগ্যের। এ যেন এক পরম পাওয়া। জীবনে এই পরশপাথরের সান্নিধ্যে আসতে পেরে আমি আমার জীবনটা ধন্য মনে করি। ১৯৮৬ সালে ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম পিজি হাসপাতাল থেকে আমাকে বারডেম হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং বারডেম হাসপাতালে ডেন্টাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মতো একজন চিকিৎসক উন্নত রাষ্ট্রে জন্ম নিলে হয়তো নোবেল পুরস্কার পেতেন। কারণ, এখনো কোথাও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও সেবার ক্ষেত্রে এ রকম বড় প্রতিষ্ঠান নেই। বহু আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করা হয়েছে এবং সেখানে বিখ্যাত বিখ্যাত ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও সংগঠককে বিভিন্ন বক্তৃতায় বলতে শুনেছি, ডায়াবেটিসের জন্য কোনো রোল মডেল হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে হলে ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি’ বা বারডেম হাসপাতালের নাম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ এবং সে দেশের নাগরিক হিসেবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এমন স্বীকৃতি বিরাট সম্মানের ব্যাপার।
একজন ডায়াবেটিক রোগী যদি তার ডায়াবেটিসের সুগার লেভেল স্বাভাবিক রাখতে চান, তবে তার নিয়মিত ওষুধ (ট্যাবলেট বা ইনসুলিন) ব্যায়াম ও খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারে যেমন শৃঙ্খলা বা নিয়মকানুন (ডাক্তারের পরামর্শ ও পথ্যবিদের খাদ্যতালিকা) মেনে চলবেন, ঠিক তেমনভাবে তিনি কিন্তু মুখের ভেতরের অংশ যেমন দাঁত, মাড়ি ও জিহ্বার যত্ন নেবেন। কারণ মুখের ভেতরে দাঁত, মাড়ি, জিহ্বা বা গালের কোনো অংশে প্রদাহ বা ইনফেকশন থাকলে ডায়াবেটিক রোগীদের ব্লাড সুগার বা শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। দাঁতের ভালো যত্ন মুখের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। মুখে যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন দাঁতের রোগ, মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা, যাকে ব্লাড সুগারও বলা হয়, যখন খুব বেশি হয় তখন ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। ডায়াবেটিস মুখের ভেতরের অনেক অংশের যেমন—দাঁত ও মাড়ি ছাড়াও শরীরের অনেক অংশকে প্রভাবিত করে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের মাড়ির রোগ মুখগহ্বরের বিভিন্ন অংশ এবং দাঁতের অন্যান্য সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
নিয়মিত স্কেলিং করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ দাঁত এবং মাড়ির ভালো যত্ন নিলে এ সমস্যাগুলো প্রতিরোধ করতে বা আরও খারাপ হওয়া অবস্থা বন্ধ করতে সহায়তা করবে। মুখ বা মুখগহ্বর সুস্থ রাখলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং এ-সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হৃদরোগ এবং কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা অনেক সহজ হবে। ডায়াবেটিস লালা পরিবর্তন করে মুখকে প্রভাবিত করতে পারে, তরল যা মুখকে ভিজা রাখে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে লালা কমে গেলে মুখে ডেন্টাল ক্যারিজ বা দন্তক্ষয় বেশি হয়। ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু ওষুধের কারণে মুখের লালা গ্রন্থিগুলো কম লালা তৈরি করতে পারে। যখন কম লালা প্রবাহিত হয়, তখন মুখগহ্বর ও মাড়ির রোগ এবং মুখের অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস লালায় গ্লুকোজের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়াবেটিস দেখা দেয়, তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বা ব্লাড সুগার খুব বেশি হয়। রক্তে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজও লালায় গ্লুকোজ তৈরি করতে পারে। এই গ্লুকোজ ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া খাবারের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্লেক নামক নরম আঠালো ফিল্ম তৈরি করে, যা দাঁতে গর্ত বা ক্ষয় সৃষ্টি করে। যদি খাবারের আবরণ অপসারণ না হয়, তবে এটি মাড়ির লাইনের কাছে দাঁতের ওপর তৈরি হতে পারে এবং টার্টার নামক শক্ত আবরণ হয়ে যেতে পারে, যা মাড়ির রোগের কারণ হতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে মুখের এ সমস্যাগুলো থাকলে দাঁতের ও মাড়ির ক্ষতি হতে পারে। মাড়ির রোগ যাকে পিরিওডন্টাল গাম ডিজিজও বলা হয়। এটি ডায়াবেটিস সম্পর্কিত মুখের সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় রোগ এবং গুরুতর সমস্যা সৃষ্টিকারী রোগ। চিকিৎসা না করা হলে, রোগটি পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়, মাড়ি ফোলা বা রক্ত পড়া অবস্থা থেকে দাঁত পড়ে যাওয়া পর্যন্ত। রক্তে গ্লুকোজের উচ্চমাত্রা উপস্থিতি মাড়ির রোগ মৃদু থেকে গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন জিনজিভাইটিস থেকে পেরিওডনটাইটিজ।
ডায়াবেটিস থেকে মুখের সমস্যাগুলো কীভাবে প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা করা যায়, সে সম্পর্কে দাঁতের ডাক্তারের বা ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ মেনে চলা প্রয়োজন। যদি ডেন্টিস্টের কাছে যেতে নার্ভাস বোধ করেন, তাহলে ডেন্টিস্ট এবং কর্মীদের ভয় সম্পর্কে বলুন। ডেন্টিস্ট প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা দিতে পারবেন।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক
(প্রকাশিত নিবন্ধের বক্তব্য ও দায়িত্ব লেখকদের নিজস্ব)
মন্তব্য করুন