সম্প্রতি দেশে অ্যানথ্রাক্স রোগের খবর আবারও আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স এখন আর অজানা কোনো রোগ নয়। ২০০৯ সালে পাবনায় মানুষের মধ্যে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি বছরই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এবার গাইবান্ধা ও রংপুরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধা জেলার কিশামত সদর গ্রামের কেউ চোখ ফোলা নিয়ে, কেউ হাতে ফোসকা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাদের কারও এক হাতে, কারও দুই হাতেই ফোসকা পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম ও লোকমুখে শুনে অনেকেই আসছেন পরিস্থিতি দেখতে। খবরে প্রকাশ, অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ২২ জনের মধ্যে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ পাওয়ার পর আতঙ্ক বিরাজ করছে। অবশ্য স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ওই নারী অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি।
গাইবান্ধা ছাড়াও রংপুরের বিভিন্ন উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, রংপুরের পীরগাছা থেকে ১২টি, কাউনিয়া থেকে ৪টি ও মিঠাপুকুর থেকে ৫টিসহ ২১টি নমুনা বিভিন্ন মানুষের শরীর থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তার মধ্যে ১১টিতেই অ্যানথ্রাক্স পজিটিভ ধরা পড়েছে। গত চার দশকে অ্যানথ্রাক্স অন্তত ১৬ জেলায় শনাক্ত হয়েছে। রোগটি নিয়ে উত্তরের জনপদে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। কমে গেছে গরু-ছাগলের মাংস বেচাকেনাও। গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে কৃষকরা।
অ্যানথ্রাক্স মূলত ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ, যা গবাদি পশু থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এটি সংক্রামক হলেও, যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ সাধারণত ঘটে সংক্রমিত পশুর মাংস, চামড়া বা রক্তের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় এখনো কাঁচা মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না, যা ঝুঁকি আরও বাড়ায়। অনেক ক্ষেত্রেই পশু অসুস্থ অবস্থায় জবাই করা হয়—এতে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে।
সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি চালু রাখলেও মাঠপর্যায়ে কার্যকারিতা সবসময় নিশ্চিত হয় না। অনেক কৃষক এখনো জানেন না অ্যানথ্রাক্স কীভাবে ছড়ায় বা কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়। তাই সচেতনতা বাড়ানোই এখন সবচেয়ে জরুরি। স্থানীয় প্রশাসন, পশুচিকিৎসক ও গণমাধ্যমের সমন্বয়ে এ সচেতনতা অভিযান জোরদার করতে হবে।
বাংলাদেশে প্রথম অ্যানথ্রাক্স রোগ শনাক্ত হয় ১৯৮০ সালের দিকে, তবে সেটি ছিল মূলত গবাদি পশুর মধ্যে। মানুষের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণ প্রথম স্পষ্টভাবে শনাক্ত হয় ২০০৯ সালে। ওই সময় সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে, যখন পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় কয়েকজন মানুষ অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই সংক্রমিত পশুর মাংস কাটার বা জবাইয়ের কাজে যুক্ত ছিলেন। এরপর ২০১০-১১ সাল পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন সময়ে অ্যানথ্রাক্সের ছোট-বড় প্রাদুর্ভাব দেখা যায়; বিশেষত রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জসহ উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে। এ ঘটনার পর থেকেই সরকার গবাদি পশুর টিকাদান কর্মসূচি, সংক্রমিত পশু দাফনের নিয়ম ও সচেতনতামূলক প্রচারণা জোরদার করে।
চিকিৎসাবিদদের মতে, অ্যানথ্রাক্স শুধু চামড়ায় উপসর্গ হয়। এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এ রোগ কোনো ছোঁয়াচে নয়। আমরা মনে করি, অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং এটি সচেতনতা ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার একটি চ্যালেঞ্জ। সরকার, কৃষক ও সাধারণ মানুষ—সবপক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
মন্তব্য করুন