ইগো কিন্তু গেল না। ইগো অটুট রেখেই ধার্য হয়েছে ১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের তারিখ। সরকারের যে তিনটা দল (বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি) একটু বেশি ‘আপনার আপন’, তাদের মধ্যেই ইগো সবচেয়ে বেশি। বাকিরা বলতে গেলে ধইঞ্চার পজিশনে। মসনদ না পেলেও ভাগে যৎসামান্য কিছু পেলেই শুকরিয়া জানাতে হচ্ছে তাদের। এরপরও দেশে ঐক্যে কবুল জারি রাখতে হচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে যে অনৈক্য, বিভেদ, সংঘাত, বিভক্তি রেখায় অবিরাম টোকা পড়ছে মসনদমুখীদের মধ্যে, সেই ভাবনা তেমন নেই। ছোটরাও যে দীর্ঘমেয়াদে চুপ করে থাকবে না, সেই সুর ও মতিগতি সনদের তারিখ ঘোষণার দিন বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ছিল স্পষ্ট। সনদটি আগামী দিনের মসনদের কী রক্ষাকবচ দেবে, সেই বিষয়-আসয় তো রয়েছেই। সনদ বাস্তবায়নের উপায়ও এখনো চূড়ান্ত করেনি কমিশন। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধ আছেই।
গণভোটের সময়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছে কমিশন। সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে রোববারের মধ্যে সুপারিশ দেবে কমিশন। সেখানেও কথা আছে। বাস্তবায়নের সুপারিশ সনদের অংশ হবে না। সব ঠিকঠাক থাকলে ১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ সই হবে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে থাকবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা। এর আগেই কমিশন জুলাই সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেবে। সেখানে বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত থাকবে। এ নিয়ে পরিশ্রম গেছে অন্তহীন। গত বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সেগুলো হলো সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। ফেব্রুয়ারিতে এ কমিশনগুলো তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেয়।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কিছু প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এই ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল আলোচনায় অংশ নেয়। তবে সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের পাঁচ দিন আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি। কিছুটা বেগতিক অবস্থায় গত বুধবার রাতে আলোচনায় দলগুলোর অনড় অবস্থানের মুখে ঐকমত্য কমিশন জানায়, বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে সুপারিশ দেবে কমিশন। দেশের প্রধান দল বিএনপি শুরু থেকেই বলে আসছে, জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা যাবে না। সনদকে সংবিধানের ওপর নেওয়া যাবে না। আদেশ নয় বরং জুলাই সনদ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা যায়। তার ভিত্তিতে একটি নতুন অধ্যাদেশ করে গণভোট করা যায়। সনদের অঙ্গীকারনামায় যুক্ত করা হবে যে, ভিন্নমতগুলোর বিষয় দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। মসনদে যাওয়ার পর মতামত-ভিন্নমত অনুসারে হাত দেওয়া হবে সনদ বাস্তবায়নের কাজ। আগামীর মসনদে কারা যাচ্ছে, তার ভাব-নমুনা বুঝে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে প্রায় সবাই একমত। জুলাই সনদকে যতটা সম্ভব আইনি ভিত্তি দেওয়া, এটি নিয়ে জনগণের সম্মতি নেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত দেখতে চায় তারা। কারও কথাই কিন্তু চূড়ান্ত নয়। আবার মাঝেমধ্যে কথা থেকে নড়ে যাওয়ার কায়কার তো আছেই। ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ দেবে, তা বিএনপি মানবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জানানো হয়েছে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। ঐকমত্য কমিশন কী সুপারিশ দেয়, তা দেখে পদক্ষেপ নেবে তারা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট চাওয়ার মতামতও আছে। মানে আগামী নির্বাচন সংস্কারের ভিত্তিতে না হলে আগের মতোই হবে। জামায়াত ও এনসিপি চায়, সংস্কার টেকসই করতে সংবিধান আদেশ না হলেও জুলাই বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট করতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের ক্ষমতা দিতে হবে। ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোও সনদ ও গণভোটে থাকতে হবে। যুক্তিতে সবাই কড়া। কমিশনের সুপারিশে কী আসে, সেটা দেখে মসনদের ভাও বুঝে এগোবে জামায়াত। সংস্কার নিয়ে এক বছর কাজ করার পর এ হলো অবস্থা। এনসিপিও চায় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশগুলো আগে দেখতে। সবারই তালগাছ আয়ত্তের বাসনা। মসনদের গ্যারান্টি বা ভাগে বেশি পাওয়ার বাসনা।
সনদে সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি ধাপের কথা বলেছেন। কমিশনও মনে করে, একটি বিশেষ আদেশ জারি করে তার ভিত্তিতে গণভোট করতে হবে। এ ছাড়া আগামী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকা পালনের (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) ক্ষমতা দিতে হবে এবং কতদিনের মধ্যে সংবিধান-সংস্কার করা হবে, তাও নির্ধারণ করে দিতে হবে। এমন সমীকরণ ও নানান হিসাব বাকির খাতায় তোলা রেখেই ১৫ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আয়োজন চলছে। এমন সময়ে আরেকটি দশ কথার এক কথা ছেড়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গণতন্ত্রের ধারা বহমান রাখতে হলে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন করতে হবে বলে মত তার। সেইসঙ্গে বলেছেন একটি মারাত্মক কথা। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়, গণতন্ত্র মানে মানুষের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।’ এ কথা মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তার দল কী বলছে আর তিনি কী বলছেন। ভাবনায় পেয়ে বসেছে অনেককে।
এমন অবস্থার মধ্যেই গেল বুধবার বিকেল থেকে দলগুলোর সঙ্গে মুলতবি আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। শুরুতে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দলগুলোকে গণভোটের সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে দীর্ঘ আলোচনায় দলগুলো কমবেশি আগের অবস্থানই তুলে ধরে। ফলে শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য হয়নি।
দিনটিতে রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে পঞ্চম ও শেষদিনের আলোচনায় বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আলোচনা শেষ হয় রাত সোয়া ১১টায়, যা বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ওই আলোচনায় ছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
শেষদিনের আলোচনায় দলগুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। বিএনপিসহ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের পক্ষে অনড় থাকে। আর জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে অবস্থান নেয়। গণভোটের প্রশ্ন কী থাকবে, ভিন্নমত তথা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে—এসব প্রশ্নেরও নিষ্পত্তি হয়নি। এরপরও কমিশন মনে করে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য ত্রয়োদশ সংসদকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা প্রদানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে।
এ ছাড়া সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে পাঁচটি মতামত দিয়েছেন। মতামতগুলো হচ্ছে—জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নে একটি আদেশ জারি করতে হবে। এই আদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করতে হবে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য বা বৃহত্তর ঐক্য আছে এবং যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত আছে গণভোটে, এ দুটি বিষয়ে আলাদা প্রশ্ন থাকবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। পরিষদ আদেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গণভোটের অনুমোদন সাপেক্ষে জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্কারগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে।
বৈঠকে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট দেওয়ার পক্ষে মত তুলে ধরে বিএনপি। পাশাপাশি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ বেশ কিছু দল সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট দেওয়ার পক্ষে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি বলছে, নির্বাচনের আগেই গণভোট করতে। এসব নিয়ে মত-অমত-ভিন্নমতের মাঝে মোটামুটি একটা ভাবনায় বেশ মিল এসেছে। খরচ কমাতে একসঙ্গে সংসদের ভোট আর গণভোট করে ফেলা।
এটি বিরাট অর্জন। গণভোটে সবাইকে একমত করানো আরও বড় সফলতা। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর এরকমভাবে একটেবিলে ধারাবাহিকভাবে বসা এবং একটা সিদ্ধান্তে আনতে পারা সরকারের জন্যও বিরাট সফলতা। ১৯৯১ সালেও কিন্তু অল্প সময়ের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ছিল। তখন সংবিধান সংস্কার করা গেছে। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থা আনা হয়েছে। এখনো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে আসা গেছে। তখন তো এখনকার মতো রেফারি ছিল না। হুইসেল বাজাতে হয়নি। আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছে স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোই। সমানে সমান না হলেও সব দল সব দলকে সম্মান করেছে। এবার সেখানে একটা বড় ব্যতিক্রম। এই মুহূর্তে বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। তাদের ঝামেলাও বড়। দেশের সবার মধ্যে বিএনপি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ভর করেছে। এরপরও তারাই মসনদে যাচ্ছে ভেবে বাকিরাও বিএনপির সঙ্গে খায়খাতিরের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। কে কতটা বিএনপি সেটা প্রদর্শন চলছে। আপার মডেলে ভাইয়াকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা খুচরা কদর্য প্রতিযোগিতা স্পষ্ট। ফ্যাসিবাদ হটানোর পর দক্ষিণপন্থিদের শক্তিমান হয়ে ওঠায় তাদের সঙ্গেও ভিড়ছেন অনেকে। বিবিসির সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তিনি বেশ বুদ্ধিদীপ্ত জবাব ও গঠনমূলক বার্তা দিয়েছেন কিন্তু তার পরদিন তার দলের কিছু কর্মী দলের প্রয়াত মহাসচিবের বাসায় গিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। কিছু হাতিয়েছেও। এ ধারা চলতে থাকলে আগে-পরে তা মসনদ বরবাদ করে দেওয়ার একটা কুলক্ষণ ঘুরছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন