কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা সবার কাছে যেভাবে পৌঁছবে

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ
রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা সবার কাছে যেভাবে পৌঁছবে

বাংলাদেশে বিএনপিই একমাত্র দল, যা ৪৭ বছর ধরে গণমানুষের দল হিসেবে সর্বমহলে সমাদৃত। অথচ দেশের সবচেয়ে পুরোনো দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গত ৭৪ বছরেও গণমানুষের দল হতে পারেনি। হয়েছে পারিবারিক আদর্শের এক ভয়ংকর ড্রাকুলা মাফিয়া সংগঠন। দলটি শুধু পাকিস্তান আমলেই একবার সেই ছেষট্টির ছয়-দফা নিয়ে জনগণের ঘরদোরে গিয়েছিল, এরপর বাংলাদেশ পিরিয়ডে কখনো জনবান্ধব কোনো সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জনগণের কাছে যায়নি। অন্যদিকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তার পরিবার জাতির প্রতিটি দুর্যোগ সময়ে দেশ উদ্ধারে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তিন-তিনবার শহুরে জনগণ হতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রথমবার ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশ বাঁচানোর ফর্মুলা ঐতিহাসিক ‘১৯ দফা’ জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। ৪০ বছর পর ২০১৭ সালের ১০ মে বিএনপি চেয়ারপারসন আপসহীন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বার একটি ‘সমৃদ্ধ, সুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা হিসেবে ‘ভিশন-২০৩০’ জনসমক্ষে তুলে ধরেন। সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার একান্তই নিজস্ব ‘ব্রেন চাইল্ড’ রাষ্ট্র মেরামতের ‘৩১ দফা’ জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়। এরপর থেকে বিএনপিসহ তার ১১টি অঙ্গ সংগঠন বিরামহীনভাবে ‘৩১ দফা’র ওপর বিভিন্ন সময়ে ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণ সভা, কর্মশালা ও সেমিনার, লিফলেট বিতরণ ও প্রচারপত্র, জনসংযোগ কর্মসূচি, মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে প্রচার করে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচারিত তথ্যের কতটুকু সাধারণ জনগণ/ ভোটার বুঝতে পারছেন? বিএনপি কি কখনো তার ফিডব্যাক নিয়েছে? সে ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে নিচের অনুচ্ছেদে।

১. নির্বাচনী প্রচারাভিযানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ইতিহাস বলছে:

ক. ভারতের কোনো একটি রাজনৈতিক দল যখন কোনো সংস্কার প্রস্তাব জনস্বার্থে আনে এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়, তখন তারা টার্গেট করে ম্যান টু ম্যান। হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপে ফটোকার্ড আকারে দফাগুলো ছড়ানো হয়। দলীয় নেতাকর্মীরা প্রতিটি জনসভা ও রোড মার্চে প্রতিটি দফা ব্যাখ্যা করে থাকে। এমনকি প্রতিটি রাজ্যে স্থানীয় ভাষায় দফাগুলো রূপান্তরিত করে তাদের কাছে পৌঁছানো হয়।

খ. পাকিস্তানে গ্রামাঞ্চলের ভোটারদের কাছে দলের বার্তা রিচ করাতে পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম বা কমিউনিটি লিডারদের ব্যবহার করা হয়। ছোট বুকলেট নিয়ে দলীয় কর্মী ও সমর্থকরা ঘরে ঘরে গিয়ে অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় বোঝায়।

গ. যুক্তরাজ্যে দফাগুলো লেখা হয় ‘জনগণের ভাষায়’, যেখানে ৫-১০টি মৌলিক ধারণা অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় তুলে ধরা হয়। ভোটারদের হাতে পৌঁছাতে ডোর-টু-ডোর লিফলেট ক্যাম্পেইন হয়, যেখানে দলীয় কর্মীরা সাধারণ ভাষায় বুঝিয়ে বলে। বিভিন্ন টেলিভিশনে লাইভ ডিবেট করে প্রতিটি দফা ব্যাখ্যা করে থাকে।

ঘ. যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানত দফাকে ‘গল্পে রূপান্তর’ করে প্রচার করে। দফা যত বড়ই হোক, জনগণের কাছে প্রচারের সময় জোর দেওয়া হয় তিন-পাঁচটি মূল ইস্যু (যেমন অর্থনীতি, কর্ম, স্বাস্থ্য)। তারা প্রতিটি দফাকে ‘একটি গল্প’ বা ‘মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ উদাহরণ’ দিয়ে তুলে ধরা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘মাইক্রো-টার্গেটেড অ্যাডস’ দেওয়া হয়, যেখানে নির্দিষ্ট বয়স ও পেশার ভোটারদের জন্য আলাদা বার্তা থাকে।

ঙ. ফ্রান্সে দফাগুলো দলের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। প্রতিটি দফা ব্যাখ্যা করা হয় দুই মিনিটের ভিডিও বক্তৃতায়, যা ইউটিউব ও টিভিতে প্রচারিত হয়। সুশীল সমাজ দফাগুলোর ওপর ‘ওপেন ডিবেট বা সিটিজেন রিভিউ’ সভার আয়োজন করে। প্রধানত নেতা কী বলছে, তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয় ফ্রান্সের দলগুলো।

চ. জার্মানিতে দফাগুলো ‘কালার-কোডেড ইনফোগ্রাফিক’ আকারে প্রকাশ করে। নাগরিকরা অনলাইনে তাদের পছন্দের দফাটি বেছে নিতে পারে। ফলে দফাগুলোর একটা তুলনামূলক বার্তা চলে আসে।

ছ. জাপানে ছোট বই আকারে প্রকাশ করা হয়। ট্রেনে, বাসে, অফিসে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট ব্রোশিওর বিতরণ করে। স্থানীয়ভাবে দফাগুলো নিয়ে জনগণের সঙ্গে মিলিত হয়। মূল বার্তা ‘ছোট বই, বড় বার্তা’।

ওপরের আলোচনার সূত্র ধরে বলা যেতে পারে, বিএনপি রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জনগণের মনস্তত্ত্ব উভয়কে বিবেচনা করে যা করতে পারে:

একাডেমিক বা জটিল রাজনৈতিক ভাষা পরিহার করে ৩১ দফার মূল মেসেজকে প্রচার করা। প্রতিটি দফাকে একবাক্যে সার-সংক্ষেপ করা (যেমন: আমরা চাই সবার ভোটের অধিকার ফেরানো/আমরা চাই দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন)। ৩১ দফাকে চার-পাঁচটি সহজ থিমে ভাগ করা (গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান, দুর্নীতি ও সুশাসন, মানবাধিকার ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি উন্নয়ন)। প্রতিটি থিমের অধীনে পাঁচ-ছয়টি দফা তুলে ধরলে মানুষ সহজে মনে রাখতে পারবে। ইনফোগ্রাফিক, ভিডিও ক্লিপ, অ্যানিমেশন ও শর্ট রিলস তৈরি করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামে প্রচার করা। প্রতিটি দফা নিয়ে ‘এক মিনিটের ব্যাখ্যা’ (যেমন: ‘৩১ দফার ৫ নম্বর দফা বলে, বিচারব্যবস্থা হবে স্বাধীন। মানে কী? এখানে রাজনৈতিক প্রভাবে নিরপরাধ কেউ হয়রানির শিকার হবে না’)। পাড়া-মহল্লা সভা, হাটবাজারে লিফলেট, স্থানীয় ভাষায় সংলাপ আকারে প্রচার করা যেতে পারে। নাগরিক সংলাপ, ছোট ভিডিও প্রজেকশন, স্টিকার ও পোস্টার প্রচারণা করা উচিত। ৩১ দফাকে একসঙ্গে না দিয়ে প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে একটি দফাকে তুলে ধরলে তা জনগণের মনে দীর্ঘদিন থাকবে। স্থানীয় দলীয় নেতাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রিয় শিক্ষক, ইমাম, ডাক্তার, ব্যবসায়ী বা তরুণ অ্যাকটিভিস্টদের মাধ্যমে প্রচার করলে মানুষ তা বেশি বিশ্বাস করবে। তরুণদের জন্য ৩১ দফা নিয়ে ডিবেট বা আইডিয়া কনটেস্ট চালু করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী তাই বার্তাগুলোতে ন্যায়, সততা, ইমানদারিতা, সুবিচার—এ ধারণাগুলোর সঙ্গে সংযোগ করলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। প্রতিটি দফার সার-সংক্ষেপ নিয়ে ৩০-৬০ সেকেন্ডের রেডিও বা টিভি স্পট তৈরি করা যেতে পারে (উদাহারণ: আপনার ভোট আপনি দেবেন, কেউ কেড়ে নিতে পারবে না—এটাই বিএনপির ৩১ দফার প্রথম প্রতিশ্রুতি)।

বিএনপির উচিত ভোটারদের কাছে সহজেই ৩১ দফা তুলে ধরতে প্রথমেই সব দফাকে পাঁচটি থিমে ভাগ করবে (গণতন্ত্র, কর্মসংস্থান, সুশাসন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, দুর্নীতি দমন)। এরপর প্রতিটি থিম নিয়ে এক মিনিটের ব্যাখ্যামূলক ভিডিও তৈরি করবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি ও ছোট বাক্যে দফাগুলো প্রচার করা। প্রতিটি দফাকে বাস্তব জীবনের গল্পের সঙ্গে যুক্ত করবে (যেমন: ভোট না দিতে পারার কষ্ট, বেকারত্ব, বিচারহীনতা)। সবশেষ দশ পৃষ্ঠায় সহজ ভাষায় ‘জনপ্রতিশ্রুতি বই’ প্রকাশ করবে।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আবুধাবিতে বাংলাদেশের বোলিং তোপে চাপে আফগানিস্তান

বিএনপি সরকারে এলে জিডিপির ৫ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করবে : শামা ওবায়েদ

সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক মিসাইল উন্মোচন করল উত্তর কোরিয়া

বাগদান সারলেন তানজীব সারোয়ার

ইলিশ শিকারে গিয়ে জেলেদের সংঘর্ষ, জেলের মরদেহ উদ্ধার

নির্বাচনে কত সেনা মোতায়েন থাকবে, জানালেন মেজর হাকিমুজ্জামান

শিক্ষক-কর্মচারীদের উৎসব ভাতার দাবিতে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ

বিতর্কে জড়ালেন অনীত পাড্ডা

জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান পেছাল 

জাতপাত বিলোপ জোটের আত্মপ্রকাশ

১০

সমাবেশের অনুমতি ছিল না, জানালেন জাপা মহাসচিব

১১

চাকসুতে শিবির সমর্থিত প্যানেলের বিরুদ্ধে ফের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ

১২

যে শহরে ২ ঘণ্টার বেশি ফোন ব্যবহার মানা

১৩

বিপিএলে দেখা যেতে পারে নোয়াখালী দল

১৪

‘শিশুদের নোবেল’ পুরস্কারে জন্য মনোনীত রাজশাহীর মুনাজিয়া

১৫

তরুণ প্রজন্মই আগামীর বাংলাদেশ : শরীফ উদ্দিন জুয়েল

১৬

ঘর আর নেই, তবু ঘরে ফিরছে গাজাবাসী

১৭

বাসায় বানিয়ে ফেলুন চকোলেট-কফির মজাদার মোকা কেক

১৮

লালবাগ কেল্লায় গ্রুপ মেডিটেশন ও ইয়োগার আয়োজন

১৯

ট্রফি না দেওয়ায় নকভির চাকরি খেতে চায় বিসিসিআই

২০
X