উচ্চ তাপমাত্রা, ডলার সংকটের কারণে কয়লা ও গ্যাসের মতো কাঁচামালের অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, লোডশেডিংয়ের অসম বণ্টনের কারণে এতদিন বিদ্যুৎ সংকটে জনজীবন ছিল বিপর্যস্ত। আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হওয়ার পর বিদ্যুতের সংকট কিছুটা কমেছে। এখন শুরু হয়েছে পানির হাহাকার। আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে ১২ দিন ধরে পানি নেই। বোতলজাত খাবার পানি, ওয়াসা থেকে পানির ট্যাঙ্কের পানি বকশিশ দিয়ে, কিনে আমাদের দিন পার করতে হচ্ছে। ওয়াসার ট্যাঙ্কের পানিতে আবার নিকষকালো ময়লা, গোসলের অযোগ্য। তাই গোসল করতে হচ্ছে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। সব কালো মেঘের আড়ালে যেমন একটি রুপালি রেখা থাকে, এ ক্ষেত্রেও নিজের ও পরিজনদের অসুবিধা হলেও পারস্পরিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। আসলেই অভাব ও সংকট মানুষকে কাছাকাছি এনে দেয়—যেমনটি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। আমাদের এলাকায় গ্যাসের সংকট না থাকলেও জানা গেছে, গোপীবাগ, আর কে মিশন রোড, স্বামীবাগ, মানিকনগর, গোলাপবাগ, ওয়ারী, উত্তর মৈশুণ্ডি, দয়াগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, বকশীবাজার, দক্ষিণ কমলাপুর, বনশ্রী, পূর্ব ও পশ্চিম রামপুরাসহ অনেক এলাকায় দিনে বেশ কয়েক ঘণ্টা গ্যাসের চুলা জ্বলছে না। কাজীপাড়া, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া, তেজগাঁও, কাফরুল, পূর্ব ও পশ্চিম শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুরের বিভিন্ন সেকশন, সেনপাড়া পর্বতা, কল্যাণপুর, ধানমন্ডির রায়েরবাজার, নূরজাহান রোডসহ পুরো মোহাম্মদপুরেও তীব্র সংকট বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া শিল্প ও কারখানায় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার সংবাদ তো আছেই।
কারও কারও জন্য সংকট মানেই সুযোগ : বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংকট জনজীবন অসহনীয় করে তুললেও কারও কারও জন্য অপার সুযোগ এনে দেয়। বিদ্যুতের সংকটের সুযোগ নিয়ে একটি গোষ্ঠী আমাদের ওপর দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংগ্রহ আইন, কুইক রেন্টাল, মাত্রাতিরিক্ত ক্যাপাসিটি চার্জ ও আদানির উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎ এবং এফএসআরইউর মাধ্যমে সিএনজি আমদানি চাপিয়ে দিয়েছে। চলমান পানি সংকটের বিষয়ে আমাদের বলা হয়েছে, সমস্যা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তাই আমাদের বহুতল ভবনে ডিপ টিউবওয়েল বসানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যার জন্য ১০ লাখ টাকা লাগবে। এজন্য নাকি কড়ি ঢাললেই ওয়াসার অনুমোদন পাওয়া যায়! একবার ভাবুন, ঢাকার প্রতিটি বহুতল ভবনে একটি করে ৫০ হাজার ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ওপর এর কী সর্বনাশা প্রতিক্রিয়া হতে পারে? গ্যাস সংকটের সুযোগে তিতাস গ্যাসের একশ্রেণির মিটার রিডারের শিল্পপতি হয়ে ওঠার মতো রূপকথার কাহিনি আমাদের সবার জানা আছে।
প্রচলিত সমাধানের সীমাবদ্ধতা : বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সমস্যার সাধারণ সমাধান হলো এগুলোর উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ বাড়ানো। এক সময় বিদ্যুৎ ও পানি আমদানি করা না গেলেও এখন তা করা যায়। আমরা ভারতের আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কিনি। সিঙ্গাপুর পানি আমদানি করে মালয়েশিয়া থেকে। প্রথমেই নিজের পুরোনো কর্মস্থল বিদ্যুৎ নিয়ে কথা বলি। সারা দেশে এ মুহূর্তে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ দিতে হলে চলতি নিয়ম (থাম্ব রুল) অনুযায়ী প্রায় ৩২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রয়োজন হবে। যেহেতু সব সময়ই কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র শাটডাউন বা বিভিন্ন কারণে বন্ধ থাকে, তাই আরও ২০ শতাংশ যোগ করে এর পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ৩৮ হাজার ৮৮০ মেগাওয়াটে। এর বিপরীতে আমাদের গ্রিড সংযুক্ত স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট, অর্থাৎ আরও প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট যোগ করতে হবে। শুধু উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ালেই হবে না, সমহারে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন, সাব-স্টেশন প্রভৃতি বাড়াতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো—আমাদের কি সে পরিমাণ বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ আছে? এজন্য যে পরিমাণ অতিরিক্ত জ্বালানির প্রয়োজন হবে আমরা কি তার জোগান দিতে পারব? বিদ্যুৎ ও এর উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা কি আমাদের আছে? বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা যোগ করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল কি আমাদের আছে? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হলো—না। একই ধরনের হিসাব পানি ও গ্যাসের জন্য দাঁড় করানো যায় এবং আমাদের একই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাহলে আমাদের করণীয় কী? একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হতে পারে নেগাওয়াট।
নেগাওয়াট কী : আমরা সবাই জানি বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের পরিমাপের ইউনিট যথাক্রমে ওয়াট, লিটার ও সিএফটি। মেগা শব্দের অর্থ মিলিয়ন। তাই মেগাওয়াট মানে এক মিলিয়ন ওয়াট বিদ্যুৎ। পরিবেশবাদী এমোরি লভিনসের ধারণাটি আমাদের দেশে প্রচলিত প্রবাদ বাক্য, ‘এক টাকা সঞ্চয় করা আর এক টাকা আয় করা সমান’ এর অনুরূপ। তার মতে, দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে এক মিলিয়ন ইউনিট বা এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা হলে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজন কমে। এমোরি লভিনস এটাকেই ‘নেগাওয়াট’ বলেছেন। নেগাওয়াটকে ওয়াটের নেগেটিভ ওয়াট হিসেবে ভাবা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, আমাদের শুধু মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে। এমোরি লভিনসের ধারণাটি পানি সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে নেগালিটার ও গ্যাসের ক্ষেত্রে নেগাসিএফটিতে সম্প্রসারিত করা যায়।
নেগাওয়াট অর্জনের কৌশল ও এর উদাহরণ : নেগাওয়াট অর্জনের কৌশল হলো জ্বালানি সাশ্রয়ী হওয়া এবং এর ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি। এর দুটি দিক রয়েছে—এক, প্রাথমিক জ্বালানি যেমন গ্যাস, কয়লা ও পেট্রোলিয়াম ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি। দুই, মাধ্যমিক জ্বালানি যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সমপরিমাণ গ্যাস, কয়লা, পেট্রোলিয়াম ব্যবহার করে অধিকতর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এর একটা উদাহরণ হলো কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, যা জ্বালানি ব্যবহার করে গ্যাস টার্বাইনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আবার এ প্রক্রিয়ার নির্গত তাপ দিয়ে স্টিম টার্বাইনে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। একইভাবে পুরোনো ঢাউস বয়লার বদলে জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ বয়লার স্থাপন করলে কম গ্যাস ব্যবহার করে একই কাজ সম্পাদন করা সম্ভব। বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি ১০ ওয়াটের এলইডি বাল্ব দিয়ে আগে ব্যবহৃত ১০০ ওয়াটের বাল্বের সমপরিমাণ আলো পাওয়া যায়। জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষ ফ্রিজ, টিভি, এসি ব্যবহার করে অনুরূপভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব। বাজারে এ ধরনের নানান প্রযুক্তি আছে ও আসছে। এগুলোর সদ্ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের বর্তমান স্থাপত্য ও বিল্ডিং নির্মাণ কৌশল পরিবর্তন করে বাইরের আলো, বাতাস ব্যবহার করে বাতি জ্বালানো ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন কমানো। এমন আরও অনেক জ্বালানি সাশ্রয়ী পদ্ধতি আছে, যা দিয়ে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জ্বালানির প্রয়োজন কমানো যায়।
নেগাওয়াট অর্জনের সুফল : নেগাওয়াট কৌশল অবলম্বন করলে নতুন বিনিয়োগের প্রয়োজন কমে। বাড়তি বিনিয়োগ প্রয়োজন হলেও তা নতুন বিনিয়োগের চেয়ে কম হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশি হলেও তার কয়েকগুণ জীবনচক্র সুবিধায় ফিরে আসে। এর ফলে দেশি-বিদেশি ঋণ ও মুদ্রা ও জ্বালানি আমদানির প্রয়োজন কমে। সর্বোপরি এ ব্যবস্থায় দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন ও দুর্নীতি কমে।
পানির ক্ষেত্রে নেগালিটার ও গ্যাসের ক্ষেত্রে নেগাসিএফটি : একইভাবে পানি ও গ্যাসের ক্ষেত্রে নেগালিটার ও নেগাসিএফটি অনুসরণ করা প্রয়োজন, যাতে করে পানি ও গ্যাস ব্যবহারের প্রয়োজন কমে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাসক্ষেত্র ও পানি পরিশোধন ব্যবস্থায় নতুন বিনিয়োগের আগে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আওতার বাইরে চলে গেলে এসবের সরবরাহ একেবারেই থেমে যেতে পারে, যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি শহরে পানি সরবরাহ সম্ভব নয় বলে নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমোরি লভিনসের কথা দিয়ে শেষ করি ‘মানুষ ওয়াট নয়, আলো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও উৎপাদনশীল ব্যবস্থা চায়।’ আমাদের কেবল আরও বিদ্যুৎ, আরও গ্যাস উৎপাদন, আরও পানি উত্তোলনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব
মন্তব্য করুন