

রোহিঙ্গা সংকট এখন আর শুধু মানবিক ইস্যু নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এক ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার কক্সবাজারের জনসমাগম ও অপরাধচক্রের চাপ কমাতে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তর করে। পরিকল্পনাটি মানবিক সহায়তা ও নিরাপদ আবাসনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হলেও বাস্তবে ভাসানচর এখন নতুন সংকটের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভাসানচরে স্থানান্তরিত প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি এরই মধ্যে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। পালানোর এই প্রবণতা শুধু ভাসানচরের ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতাই নয়, বরং রোহিঙ্গা সংকটের গভীরতর ও কাঠামোগত সমস্যাগুলোকেও উন্মোচিত করছে।
রোহিঙ্গাদের পালানোর মূল কারণগুলো স্পষ্ট—কর্মসংস্থানের অভাব, শিক্ষার অচলাবস্থা, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার সংকট, ক্যাম্পের বাইরে যাতায়াত নিষেধাজ্ঞা, পরিবার বিচ্ছিন্নতা এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। একদিকে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি খোলামেলা, যেখানে অনেকে দিনমজুরি বা অনিয়মিত শ্রমে কিছু আয় করতে পারে; অন্যদিকে ভাসানচর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, বিচ্ছিন্ন এবং কর্মক্ষেত্র হীন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে দীর্ঘমেয়াদি বাস রোহিঙ্গাদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠছে। আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো সংগঠিত দালালচক্রের সক্রিয়তা। মাত্র তিন থেকে চার হাজার টাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা কাঠের নৌকায় রাতের অন্ধকারে নোয়াখালী বা চট্টগ্রাম উপকূলে পৌঁছে যেতে পারছে। এভাবে ভাসানচর থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা কোথায় যাচ্ছে, কী কাজে যুক্ত হচ্ছে—তা রাষ্ট্রও নিশ্চিতভাবে জানে না। ফলে বিভিন্ন অপরাধচক্রে রোহিঙ্গাদের জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে, যা এরই মধ্যে আশপাশের জেলায় নিরাপত্তা-শঙ্কা তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর শৈথিল্যও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। ভাসানচরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মূলত নৌবাহিনী, এপিবিএন, কোস্টগার্ড ও পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হলেও তাদের টহল ও নজরদারির ঘাটতির কারণে পালানো ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রশাসনিক অসংগতি, এনজিওগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব এবং ক্যাম্প ইনচার্জদের সীমিত মনোযোগ পুরো বিষয়টি আরও জটিল করে তুলেছে।
এ প্রেক্ষাপটে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাঁচটি সুপারিশ এসেছে। এগুলো হলো—জীবিকা কর্মসূচি পুনরুজ্জীবিত করা, স্থানান্তর প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে চালু রাখা, চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, শিশুদের জন্য শিক্ষা পুনরায় চালু করা এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়ানো। এগুলো বাস্তবায়ন জরুরি হলেও মূল প্রশ্ন এগুলো কি সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে সক্ষম?
বিশেষজ্ঞদের মতে, না। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বন্দিশালায় আটকে রাখলে বা দেশের ভেতর এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় সরালেই সংকট সমাধান হবে না। বরং এভাবে সমস্যাকে আরও বৃহৎ আকারে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সত্য হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ ১২ লাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক মানবতা রক্ষা করেছে, কিন্তু সীমিত সম্পদ নিয়ে এত বড় বোঝা দীর্ঘমেয়াদে বহন করা সম্ভব নয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দেড় বছর ধরে কার্যত স্থবির। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এবং বড় পরাশক্তিগুলোর নীরবতার কারণে এ প্রক্রিয়া ভেঙে গেছে। এখন প্রয়োজন কূটনৈতিক সক্রিয়তা নতুনভাবে জোরদার করা।
মন্তব্য করুন