মহসীন হাবিব
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:১২ এএম
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফেরাউন রাজবংশ ও আধুনিক শাসনব্যবস্থা

ফেরাউন রাজবংশ ও আধুনিক শাসনব্যবস্থা

এখন থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরে ফারাও বা ফেরাউনদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা ধারণা, বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চালু ছিল। সেসব বিশ্বাস, রাষ্ট্র পরিচালনার নানা অদ্ভুত রীতি আধুনিক যুগ পর্যন্ত স্রোতের মতো বয়ে এসেছে। বিশ্বাসের কথাই বলি। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩২ থেকে ১৩২৩ সাল পর্যন্ত ফেরাউনদের শেষ রাজা ছিলেন তুতেনখামেন। ১৯২২ সালে তার সমাধিস্থল খনন করেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার। এ কাজে তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন অভিজাত ইংরেজ আর্ল জর্জ এডোয়ার্ড স্ট্যানহোপ। খননকাজ শেষ হলে হাওয়ার্ড চিঠি লেখেন স্ট্যানহোপকে, ‘অভিনন্দন তোমাকে, তুতেনখামেনের সমাধিতে অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে।’ স্ট্যানহোপ ছুটে চলে আসেন ইংল্যান্ড থেকে মিশরে। উৎসাহের আতিশয্যে রাতের অন্ধকারে হাতে আলো নিয়ে ঢুকে পড়েন তারা পিরামিডের অভ্যন্তরে সমাধিতে। এ কাজটি তারা করেছিলেন মিশরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অগোচরে, অনুমতি ছাড়া। এর কিছুদিন পরেই একটি মশার কামড়ে জ্বরে পড়েন স্ট্যানহোপ এবং মিশরের একটি অভিজাত হোটেলেই তিনি মারা যান। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তুতেনখামেনের অভিশাপেই তিনি মারা গেছেন। সে সময় ‘মামির অভিশাপ’ বলে একটি টার্মই চালু হয়ে যায়। পত্রপত্রিকায় ঢালাও করে নানা নতুন নতুন চমকপ্রদ খবর প্রকাশ পেতে থাকে। এমনকি আর্থার কোনান ডোয়েলের মতো আধুনিক মানুষ বলেন, তুতেনখামেনের সমাধিস্থলের কোনো একটি উপাদানের বিষক্রিয়ায় স্ট্যানহোপ মারা গেছেন। অবশ্য সেটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল। তুতেনখামেনের সমাধিতে প্রায় পাঁচ হাজার সামগ্রী আবিষ্কৃত হয়। ফেরাউনদের বিশ্বাস ছিল, কেউ যদি ওইসব সমাধিতে গোপনে প্রবেশ করে এবং কিছু চুরি করে, তাহলে তাকে ফেরাউনদের অভিশাপে মৃত্যুবরণ করতে হবে। ফেরাউনদের কাছে চুরি আর প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মিশরীয় এ ফেরাউনরা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তারা জনসাধারণ এবং ঈশ্বরের মাঝখানে অবস্থান করতেন। জনগণও তাই বিশ্বাস করত। সুতরাং তাদের মৃত্যু নেই মনে করা হতো। তাই তাদের আত্মা সংরক্ষণের জন্য মমি করে সমাহিত করা হতো। জীবদ্দশায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই শুধু নয়, মৃত্যু হলে তাদের সেবার জন্য বিশ্বস্ত দাস-দাসিদেরও হত্যা করে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ফেরাউনদের নিয়ে এত কথা বলার কারণ একটি প্রশ্ন—আধুনিক যুগের শাসকগোষ্ঠী ফেরাউনদের বিশ্বাস থেকে খুব বেশি দূরে সরে আসতে পেরেছে কি? আমাদের সাধারণ্যের দৃষ্টিতে পরিষ্কার, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ফেরাউনদের পার্থক্য হলো, তারা তাদের দেহকে মমি করতেন আর বর্তমান যুগের দুর্বল আইনের দেশগুলোর শাসকরা মমি করেন না। তাও হয়তো করতেন, যদি ধর্মীয় বাধা-নিষেধ না থাকত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে একদল ক্ষমতা হস্তগত করতে, আরেক দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে জনগণের সামনে সর্বক্ষণ জেনেশুনে অসত্য বক্তব্য উপস্থাপন করে চলেছেন। সেটাও আবার কারা? যারা জীবনাবসান থেকে মাত্র ৫ কিংবা ১০ বছর দূরে অবস্থান করছেন। একজন মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার আর দৈহিক উপস্থিতি থাকে না। কিন্তু তার কৃতকর্ম, তার বক্তব্য সব রয়ে যায়,Ñবিশেষ করে রাজনীতিবিদ বা সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিদের। আগে তাদের বক্তব্য ও কৃতকর্মের সংবাদ খবরের কাগজে থাকত, অথবা কোনো পুস্তকে। ঘেঁটে বের করা ছিল সময়সাপেক্ষ। এখন ইন্টারনেটে ভেসে বেড়ায়, একমুহূর্তের মাউস ক্লিক করলেই বের হয়ে আসে আদ্যোপান্ত। কিন্তু এরা বোধহয় জানেন এদের মৃত্যু নেই! এ ছাড়া কোনো বোকাও কি বেসামাল অসত্য বলে যেতে পারেন? পারেন, যখন আইনের শাসন না থাকে, মিথ্যা বলার কারণে কোনো শাস্তি পেতে না হয়। আমরা অবাক হয়ে দেখি, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে যে মানুষগুলো নেতাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, নেতাদের জন্য জীবনবাজি রাখে, যেসব মানুষকে সচেতনভাবে অসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন নেতারা। কখনো কখনো অসত্য বলতে বলতে আমরা সব ভারসাম্য হারিয়ে যেতে দেখি। কোনটা জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য, কোনটা নয়; কোনটা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান তাও নির্দ্বিধায় বলতে শোনা যায়। যেমন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে বোমা হামলা। অল্পের জন্য রক্ষা পান তিনি। তাকে নেতাকর্মী যারা ঘিরে ধরেছিলেন, তারা শরীরে এখনো গ্রেনেডের স্প্রিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন। কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই ভয়ানক বোমা হামলায় ২৪ জন মানুষ স্পটে নিহত হয়। কিন্তু তার পরপরই রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা ‘দায়িত্বশীল’ লোকেরা বিবৃতি দিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে গ্রেনেডের সংখ্যা ২৬টি বলেও উল্লেখ করেছিলেন! একটি আর্জেস গ্রেনেডের ওজন ৪৮০ গ্রাম, অর্থাৎ প্রায় হাফ কেজি। ২৬টি গ্রেনেডের ওজন প্রায় ১৩ কেজি। একটি ভ্যানিটি ব্যাগে ১৩ কেজি গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে নিজের মিটিংয়ে সমবেত দলীয় কর্মীদের ওপর কেউ হামলা করবে, এমন কথাও মানুষকে বিশ্বাস করাতে চায় যারা, তাদের নিশ্চয়ই কোনো মৃত্যু নেই! এটি একটি উদাহরণ। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহসহ নানা কিছু নিয়ে এমন অসংখ্য আজগুবি গল্প রয়েছে, যা দায়িত্বশীলরা বলেন এবং জনগণের একটি অংশ তা বিশ্বাস করে। যদি অসত্য বক্তব্যের জন্য কোনো আইনগত প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয়, তাহলে যা খুশি তাই বলা যায়, বলার চর্চা তৈরি হয়। ফেরাউনদের যুগের কোনো পার্থক্য থাকে না।

তৃতীয় বিশ্বের যেসব নেতাকে কোনোদিন অর্থনৈতিকভাবে কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না, নাতিপুতি পর্যন্ত পারিবারিক পরিচয়ে বৈতরণি পার হয়ে যাবে, তারাও জনগণের অর্থ চুরি করে! শুধু চুরিই করে না, সে অর্থ দেশ থেকে পাচার করে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে বাড়ি করেন। একটিবার তারা ভেবে দেখেন না, যে মানুষগুলো তাদের বিশ্বাস করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন, তাদের অর্থের এই লোপাট করে তিনি কোন সে মমি তৈরি করবেন যে, মমিফায়েড দেহের মৃত্যু নেই! ক্ষমতায় যে বা যারাই যান, তারা কেউ ভাবেন না, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেলে এ দেশে মহান হিরো হিসেবে মানুষের মনে বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু অতি সংকীর্ণ অর্থলোভ কাউকে ছাড়ে না। এ যেন চিরাচরিত সংস্কৃতি। এমন অনেক লোককে আমরা দেখেছি, সত্তর অথবা আশির দশকে দুই বছরের জন্য হয়তো মন্ত্রিত্ব করেছেন, এখনো তার জৌলুসের কোনো শেষ নেই! বিদেশে যান চিকিৎসা অথবা আনন্দ ভ্রমণে। অথচ তার বা তাদের কোনো প্রদর্শিত আয় নেই, কোনো ব্যবসা নেই, লাভ-ক্ষতির কোনো খতিয়ান নেই। আবার এ কথাও ঠিক, আমরা যারা এসব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করি, তারাও অবস্থান পরিবর্তন হলে ঠিক একই কাজ করব। তার কারণ, আইনের সঠিক ও সমান প্রয়োগ না থাকা।

সুতরাং এ কনক্লুশনে আসতে কোনোই বাধা নেই যে, মানুষ মৃত্যুকে যেমন ভয় পায় না, তেমনি ন্যায়-অন্যায় যে কোনো প্রকার অর্থ-ক্ষমতা দ্বারা নিজেকে শক্তিশালী করে তুলতেও দ্বিধা করে না। যেসব দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে, শৃঙ্খলিত হয়েছে, তাদের নেতারা একটি বিষয় নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তা হলো, দেশের অভ্যন্তরে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে এবং আইনের শাসন সুনিশ্চিত করতে হবে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আমেরিকা। আজ যদি যুক্তরাষ্ট্রের আদালত সামান্য পক্ষপাতমূলক হয়, আজ যদি সামান্য কিছু বিচার মুখ দেখে করা হয়, সঙ্গে সঙ্গে দেশটির বেশিরভাগ মানুষ চরম উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠবে, রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়বে। কোনোক্রমেই দেশটির অখণ্ডতা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা অথবা দুর্নীতি সামাল দেওয়া যাবে না। তারপরও যে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের সম্মুখীন হলে কারও ছাড় নেই, সামান্য দয়া-সহানুভূতি পাওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে কত অঘটনই না ঘটছে! প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেওয়ার চেষ্টা অথবা বব মেনডেজের ঘুষ গ্রহণের মতো ঘটনা ঘটছে; যখন-তখন পুলিশের হত্যা, অথবা স্কুল শুটিংয়ের ঘটনা ঘটছে। তথাপি এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করা হয়। এটাই প্রমাণ যে, মানুষ অপরাধপ্রবণ, তাকে আইনের শৃঙ্খলায় বাধা ছাড়া কোনো উপদেশ, কোনো পরামর্শ, এমনকি কোনো শিক্ষা দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আইনের শাসন দিয়েই তাকে শৃঙ্খলিত করতে হয়। তা না হলে তুতেনখামেনের শাসন থেকে বের হওয়া কারও বা কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব নয়।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হবিগঞ্জে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ

২৫০ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা

‘কোরবানিতে চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ পশু বেশি আছে’

যুবলীগ নেতাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পাঠান হলো হাসপাতালে

সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়েছে

ঈদ উপলক্ষে ওয়ালটনের বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পণ্য উন্মোচন

বিদ্যুৎস্পর্শে যুবকের মৃত্যু

বাসে জাবি ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় মহিলা পরিষদের বিবৃতি

পুলিশের গাড়িতে গুলি করা ডাকাত সর্দার গ্রেপ্তার

এসএসসি পাসে ওয়ালটনে নিয়োগ, বয়স ২০ হলেই আবেদন

১০

নিপুন তো বাপকেই অস্বীকার করছে : ডিপজল

১১

২১ মে যেসব এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা

১২

জলবায়ু পরিবর্তনে ১৪ গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীরা : পরিবেশমন্ত্রী

১৩

প্যারিসে রোবটের মাধ্যমে হার্টের রিং পরানোর অভিজ্ঞতা জানালেন ডা. প্রদীপ 

১৪

উন্নত বিশ্বকে কার্বন নিঃসরণ কমানোয় মনোযোগ দিতে হবে : পরিবেশমন্ত্রী

১৫

দিনাজপুরে ফের বাড়ছে তাপমাত্রা

১৬

ফিলিস্তিনিদের হামলায় পর্যুদস্ত ইসরায়েল, ১২ সেনা নিহত

১৭

ড. ইউনূসের কর ফাঁকি মামলার প্রথম দিনের শুনানি শেষ

১৮

ঝড়ের সঙ্গে সতর্ক সংকেত জারি

১৯

ডো‌নাল্ড লুর সফরে বিএনপির মাথা খারাপ হয়ে গেছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

২০
X