আইন হলো শৃঙ্খলার নামান্তর। আইন বলে তুমি এই চৌহদ্দির মধ্যে থাকবে, তার বাইরে যাবে না এবং সেটা মেনে চলাই শৃঙ্খলা। কিন্তু আমরা তো শৃঙ্খলায় আবদ্ধ থাকতে চাই না। বেঁধেও রাখা যায় না। আইনশৃঙ্খলার বেড়ায় আমাদের আটকে রাখা যায় না।
২৮ অক্টোবর, শনিবার নিয়ে ঠিক এমনই এক ভাবনা। একটি রাজনৈতিক দল সমাবেশ ডেকেছে, তারা সমাবেশ করবে, গরম-গরম বক্তৃতা দেবে এবং সেসব শুনে কর্মীরা যার যার ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু বিএনপির ডাকা সেই সমাবেশ ঘিরে এখন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। চারদিকে একটা ভয়—কী হয়, কী জানি কী হয়! রাষ্ট্রের ভার এখন যাদের হাতে, তাদের ব্যস্ততা সীমাহীন। সারাক্ষণ প্রাণপণ প্রহরা দিচ্ছেন, এই বুঝি বেচারা রাষ্ট্র দুর্বৃত্ত দ্রোহীদের পাল্লায় পড়ল। বিএনপি জন্মলগ্ন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরস্পর বিরোধিতার রাজনীতিতে জড়িত। জাতীয়তাবাদের এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, সেই বিরুদ্ধতার মাত্রা যথাসম্ভব চড়িয়ে সেটা থেকে রাজনৈতিক লাভ নিষ্কাশন। গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ পুরো দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়েছিল বিএনপি আমলে। সেই থেকে আস্থা আর বিশ্বাসের আর কোনো স্থান নেই এই দুই দলে।
তাই বিএনপির কর্মসূচি মানেই আওয়ামী লীগের জন্য বড় চিন্তা, সহিংসতার শঙ্কা। সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপি গত এক বছর ধরে যে চূড়ান্ত আন্দোলন করছে, তার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এ কর্মসূচি দিয়েছে। তারা এও বলছে যে, ৩ নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারকে হটানো হবে। তাই আওয়ামী লীগের কাছে ২৮ অক্টোবর এবং এর পরবর্তী সাত দিন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি দেশব্যাপী আন্দোলন করেছে। বাধা উপেক্ষা করে বড় বড় সমাবেশ করেছে। কিন্তু সরকারের জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতে অবশ্য এর চেয়ে অনেক বেশি সহিংস আন্দোলন করেছিল, নির্বাচনের পরও বড় বড় সংঘাত হয়েছে। কিন্তু সরকার সেই মেয়াদ পূর্ণ করে পরবর্তী সময়ে আবার নির্বাচন করেছে, সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পায়নি। তাই এবার তার লক্ষ্য শুধু নির্বাচন বর্জন না, নির্বাচন ঠেকানো না, নির্বাচনে অংশগ্রহণও না। একমাত্র লক্ষ্য শেখ হাসিনাকে তার আসন থেকে নামানো। আওয়ামী লীগও এটা জানে, ফলে সব প্রস্তুতি নিচ্ছে ২৮ অক্টোবর ও তার পরবর্তী দিনগুলোর জন্য। বিএনপির এবারের লক্ষ্য রাজধানী ঢাকাকে অচল করে দেওয়া। ২০১৩, ’১৪ ও ‘১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে সহিংস আন্দোলন করে, পুলিশ মেরে, যানবাহন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদে আগুন ধরিয়ে দিয়ে একটা নরক তৈরি করতে পেরেছিল, ঢাকাকে সারা দেশ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছিল, কিন্তু ঢাকায় সরকার নিরাপদেই ছিল। সরকারের পতন হয়নি। এবার তাই সব আয়োজন ঢাকাকে ঘিরে। ঢাকার বাইরে থেকে লোক আনছে দলটি। বিএনপির হাইকমান্ড এবারের আন্দোলন বাঁচামরার লড়াই হিসেবে বিবেচনা করছে। বিএনপি মনে করে, এবারের আন্দোলন একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছে এবং তাদের বিজয় আসবে। আওয়ামী লীগ যতই ভয়ভীতি দেখাক, দাবি আদায়ের আন্দোলন আটকাতে পারবে না। বিএনপির এ আত্মবিশ্বাসের মূল কারণ সরকারের ওপর বিদেশি চাপ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, স্যাংশনের আশঙ্কা এবং ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের অতি সক্রিয়তা। হাস বিএনপির আন্দোলন যেন নির্বিঘ্নে হতে পারে, সেজন্য ছুটে গেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও। তাহলে আওয়ামী লীগ কী করবে? পুলিশ, র্যাব, আনসারের পাশাপাশি দলীয় কর্মীদেরও মাঠে রাখছে তারা। রাজধানী ঢাকার রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছুটা আক্রমণাত্মক থাকতে চায় আওয়ামী লীগ। কারণ দলের ভয়, বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলোতে বসে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের এ ভয়ের কারণও আছে। দীর্ঘ বিরতির পর বিএনপির সঙ্গে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী ২৮ অক্টোবর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন আগামী ৩ নভেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে বলে জানিয়েছে এবং ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ থেকেই বিএনপি তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দিতে পারে। কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ২৮ অক্টোবর ঢাকার প্রতিটি রাস্তায় হাঁটতেও যেন আওয়ামী লীগ, সামনে আওয়ামী লীগ, পেছনে আওয়ামী লীগ থাকতে হবে। সারা শহরে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকবে। অন্যদিকে চূড়ান্ত আন্দোলনে থাকা বিএনপি কর্মীরা সঙ্গী হিসেবে মাঠে পাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরের মতো দলকে, যারা রাজপথে সংঘাতে অনেক পারদর্শী। আছে আরও কিছু ইসলামী দলও। সব মিলিয়ে বলতেই হচ্ছে যে, ২৮ অক্টোবর থেকে ভয়ংকর সংঘাতের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের রাজনীতি এমনিতেই সহিংসতাপ্রিয়। যে বাঙালি ভালো করে ইনজেকশন নিতে পারে না (শরীরে ছুঁচ ফোটাতে হবে বলে), রক্ত-টক্ত দেখতে পারে না, হাত-পা কেটে গেলে বাবারে-মারে করে চেঁচায়, তারা কিন্তু বছরের পর বছর ভোটের আগে, ভোটের সময় এবং ভোটের পরে রাজনৈতিক সহিংসতা করে, খুনোখুনি করে। এর অন্যতম কারণ, রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থাকে কোনো মর্যাদা না দেওয়াটা আমাদের রাজনীতির হাড়ে-মজ্জায় বসবাস করে।
আগামী শনিবার, ২৮ অক্টোবর ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়বে। এদিন নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। কিন্তু এটি তো শুধু বিএনপিদলীয় সমাবেশ না। প্রায় ৩৪টি দল সমাবেশ ডেকেছে। সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো তাদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে থাকবে বলে জানিয়েছে। ফল—এই শহর স্তব্ধ হতে বাধ্য। প্রশ্ন হলো—সমাবেশ হবে, বক্তৃতা হবে, তারপর কী? বিএনপি এর মধ্যেই সমাবেশের স্থান নিয়ে গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের মতো ঝামেলায় পড়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কোনোভাবেই নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ হতে দেবে না, যেমন করে দেয়নি গত ১০ ডিসেম্বর। অনেক টানাহেঁচড়ার পর শেষ পর্যন্ত কমলাপুরের গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে বিএনপি। এবার আবার সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের স্পষ্ট কথা, গোলাপবাগেই করতে হবে সমাবেশ। বিএনপি নেতারা অটল যে, তারা পল্টনেই করবে তাদের সমাবেশ।
যদি গোলাপবাগে সরে যেতে হয় তাহলে প্রাথমিক বিজয় হবে সরকারের ও সরকারি দলের। তারা বলতে পারবে বিএনপি নির্ধারিত জায়গায় সমাবেশ করতে পারেনি। সমাবেশ এক জায়গায় করলেই হয়। দেখতে হবে সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণ যোগ দিতে পারছে কি না এবং সেই সমাবেশ থেকে পরবর্তী কী ঘোষণা আসে সেটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে এটা এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও যে, গো ধরেও নিজের পছন্দের জায়গায় সমাবেশ করতে পারেনি। আর যদি বিএনপি করতে পারে, তাহলে এ পর্যন্ত বিএনপির বড় সাফল্য হবে এটি।
বিএনপির সামনে আন্দোলনে সফল হওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে যদি নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হয়ে যায়, তাহলে আন্দোলনে মানুষকে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এর সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও জড়িত। টানা ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। আরেকটি নির্বাচন যদি আওয়ামী লীগ করে ক্ষমতায় আসে, তাহলে সেটি হবে বড় পরাজয়। ২৮ অক্টোবরের দিনটি শান্তিপূর্ণভাবে পার করে দিতে পারলে, বিএনপির ভেতরে এবং সঙ্গে থাকা অনেক শরিককে নির্বাচনে আনার টোপে ফেলতে পারে সরকার। যদি সরকার সেটা করতে পারে তাহলে আন্দোলনের গতি কমে যেতে পারে। সরকারও বিএনপি ছাড়াই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে বলে দেশ-বিদেশকে দেখাতে পারবে। এ বাস্তবতা বিএনপি নেতারা জানেন। তাই ভয়ভীতি, গ্রেপ্তার, মামলা, হামলাকে তারা আমলে নিতে চাইছেন না। তবে লোভের ভয়টা আছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব শরিক জোটের নেতাদের বোঝাতে চাচ্ছেন যে, একজন রাজনীতিকের শেষ কথা হচ্ছে জনগণ। কোনো লোভ বা টোপে পড়ে জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে গেলে এর পরিণতি কখনো ভালো হয় না। তাই ২৮ অক্টোবর অনেক সমীকরণ মেলানোর দিন বাংলাদেশের রাজনীতির।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন