দেশে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ‘মরণপণ’ লড়াই চলছে, তা অব্যাহত থাকলে সংঘাত-সহিংসতা চলমান থাকবেই, সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র যেমন নির্বাসনে যেতে পারে, তেমনি দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ দল বাংলাদেশে গত ৭-১৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজের ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেশে ফিরে যায়। গত ১৪ অক্টোবর ওয়াশিংটন থেকে তারা এক বিবৃতিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অর্থবহ সংলাপসহ পাঁচ দফা সুপারিশ ঘোষণা করেছে।
মার্কিন পর্যবেক্ষণ দল আরও বলেছে, বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং আসন্ন নির্বাচন হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি লিটমাস টেস্ট। তারা বলে, পাঁচ দফা সুপারিশ একটি রোডম্যাপ তৈরি করবে, যা গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অর্জনে সহায়তা করতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সংলাপ শব্দটি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে শর্তহীন সংলাপ করতে চাইলে তাতে আওয়ামী লীগ রাজি হতে পারে। তিনি ১৭ তারিখে বলেছেন, সংবিধান থেকে একচুলও সরবে না আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এখন আমরা একা নই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তি যারা গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ, তারা সবাই একই কথা বলছে। সেই অঙ্গীকার আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে, সাহস জোগাচ্ছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুমত চর্চার খুব অল্পই অবশিষ্ট আছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। অর্থাৎ দেশের দুটি বৃহৎ দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যেমন নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে একমত হতে পারছে না, তেমনি বিশিষ্টজনও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব দেখছেন।
সরকারি দল অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য গিয়ে হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। আবার বিরোধী দল লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে হারতে রাজি নয়। এ অবস্থায় নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সমঝোতা না হলে সংঘাত-সংঘর্ষ-প্রাণহানি অনিবার্য।
বর্তমান ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক (ওয়েস্টমিনস্টার) সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায়’ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানের স্থায়ী পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘উইনার টেকস অল’—চূড়ান্ত বিবেচনায় এ বাক্যটির মধ্যেই সব সমস্যা নিহিত। তাই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ‘আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা’ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্য এবং তার যেসব দেশ উপনিবেশ ছিল (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া অন্তর্ভুক্ত), সেসব দেশেই এ সংসদীয় নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। এশিয়া মহাদেশের বেশিরভাগ দেশের মতো বাংলাদেশেও এ সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থাই চলমান।
বিশ্ব প্রায় ৬০ শতাংশ দেশে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা বর্তমান। প্রাচীন ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার’ (ওইসিডি) সদস্য ৩৬টি উন্নত দেশের মধ্যে মূল ১৯টি দেশই আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং নব্বইয়ের দশকে যখন সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে গণতন্ত্র চালু হয়, তখন তাদের ১০টি দেশই আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। উন্নত দেশের বাইরেও, বহু উন্নয়নশীল দেশে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। নিউজিল্যান্ডসহ আরও দেশ স্বয়ং যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস তাদের পার্লামেন্ট এবং অ্যাসেম্বলির জন্য আনুপাতিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। শ্রীলঙ্কা পুরো নির্বাচনে এবং নেপাল আংশিকভাবে আনুপাতিক নির্বাচন প্রবর্তন করেছে। উন্নত বিশ্বে আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রায় সার্বজনীন। সুতরাং পুরো বিশ্বই আনুপাতিক নির্বাচনের পথে হাঁটছে। আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন যথারীতি নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা দেওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনসংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ড করবে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এ নির্বাচন ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন আয়োজন করা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। এ নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রতিটি নিবন্ধিত দল যত সংসদীয় আসনের জন্য প্রার্থী দেবে ততজন প্রার্থীর নাম সেই দল নির্বাচন কমিশনের তপশিল অনুযায়ী কমিশনে জমা দেবে। এ প্রার্থীদের দল নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে তাদের অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরবে। দলটি শুধু তার নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। এভাবে অনেক দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর ভোটার দলগুলোর প্রতীকের মধ্য থেকে তার পছন্দের দলের প্রতীকে ভোট দেবেন। নির্বাচনে যে দল দেশের মোট ভোটের মধ্যে থেকে প্রদত্ত ভোটের যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে সেই দলের সংসদ সদস্যের সংখ্যা নির্ধারণ হবে। দলটি যতজন সংসদ সদস্য পাবে, দলটির পক্ষ থেকে আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া প্রার্থীর তালিকা থেকে ক্রমানুসারে ততজনকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। নির্বাচন কমিশন গেজেটের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের নাম চূড়ান্ত ঘোষণা দেবে। এ পদ্ধতির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুধু একটি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করার সুযোগ কম, তাই ‘উইনার টেকস অল’—এ সুবিধা কোনো দলই পাবে না বিধায় এক ধরনের জোট সরকারের মতো শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হবে। কারণ, এ নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটের আনুপাতিক হারে অধিকাংশ ছোট-বড় দলের প্রতিনিধি সংসদে স্থান পাবে। তাই আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় যে সুফলগুলো পাওয়া যেতে পারে তা হলো—আইনের শাসন, সুশাসন, মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা, নির্বাচনকালে সংকীর্ণতার পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাওয়া, ইত্যাদি।
দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রচলিত সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রত্যেক সংসদীয় আসনে এককভাবে বা জোটবদ্ধভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। কোনো দলের প্রার্থীরা তাদের দলের বা তাদের দল ইচ্ছা করলে জোটের মধ্যে বড় দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। এ প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা জোটের মধ্য থেকে যে দল বা জোট দেশের মোট ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে কমপক্ষে ১৫১টি আসনে জয়ী হবে, সেই দল বা জোটই সরকার গঠন করবে। যদি কোনো দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে যে কোনো দল বা জোট অন্য কোনো দল বা জোটের সমর্থন নিয়ে বা দিয়ে ১৫১টি আসন পূরণ করে সরকার গঠন করতে পারে।
বাংলাদেশে এ পদ্ধতিতে শুধু ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচন ছাড়া সব জাতীয় নির্বাচনে সরকার গঠনকারী দল দেশের মোট ভোটের মধ্যে প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের চেয়ে কম ভোট পেয়েছে। ধরা যাক, জাতীয় নির্বাচনে ১০টি দল বা জোট থেকে ১০ জন করে প্রার্থী প্রতিটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোট প্রদত্ত ভোট তাদের মধ্যে কমবেশি করে ভাগ করে নিল। তুলনামূলকভাবে যে দল বা জোট বেশি আসন থেকে জিতবে, সেই দল বা জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক নির্বাচনে সংখ্যাল্প ভোট পেলেও সরকার গঠন করবে। যেমন বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ৩০.০৮, ৩৭.৪৪, ৪০.১৩ ও ৪৮.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্রমানুসারে ৮৮, ১৪৬, ৬২ ও ২৩০টি আসন পেয়েছিল। এ চারটি নির্বাচনে বিএনপি ক্রমানুসারে ৩০.৮১, ৩৩.৬০, ৪০.৯৭ ও ৩২.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে যথাক্রমে ১৪০, ১১৬, ১৯৩ ও ৩০টি আসন পেয়েছিল। অর্থাৎ এ সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক চারটি নির্বাচনে সব কয়টি নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বরাবরই সংখ্যাল্পের ভোটারের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে। আবার এ চারটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করলে আওয়ামী লীগের আসনসংখ্যা হতো যথাক্রমে ৯০, ১১২, ১২০ ও ১৪৪ এবং বিএনপির আসনসংখ্যা হতো ক্রমানুসারে ৯২, ১০১, ১২৩ ও ৯৭। অর্থাৎ সরকার গঠন করতে এই দুই দল মিলে অথবা তাদের বাইরের এক বা একাধিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে হবে। তার মানে এ ধরনের জোট সরকার গঠিত হবে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট