প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৮ জুন ২০২৩, ১০:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুতে সাপলুডুর খেলা

বিদ্যুতে সাপলুডুর খেলা

বিদ্যুৎ আসলে একটা অভ্যাসের মতো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যখন ঘনঘন লোডশেডিং হতো, আমাদের ছেলে প্রসূন তখন অনেক ছোট। গরমে তার খুব কষ্ট হতো। তখন সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাকে বলতাম, তুই তো এখন লোডশেডিংয়ে কষ্ট পাস। আমাদের ছেলেবেলায় তো বিদ্যুৎই ছিল না। শুনে প্রসূন অবাক হতো, তোমাদের আইপিএস ছিল না। আসলেই আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়। সন্ধ্যায় হারিকেন পরিষ্কার করে পড়তে বসতাম। গরমে ভরসা ছিল তালপাতা বা সুপারির বাকলে তৈরি হাতপাখা। দখিনের জানালা খুলে ঘুমাতাম। বাতাস আসত, সঙ্গে ভেসে আসত জানালার পাশেই লাগানো হাসনাহেনার সৌরভ। বিদ্যুতের ব্যাপারটা আমাদের মাথাতেই ছিল না, তাই কোনো চাহিদাও ছিল না। আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, তখন আমাদের গ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ এলো। সে কি উৎসব, সে কি আনন্দ!

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-০৬ সময়কালের শাসনামল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা অন্ধকার সময়। অন্যসব দুঃশাসনের কথা বাদ দিলেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে আক্ষরিক অর্থেই সময়টিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা যায়। বিদ্যুৎ নিয়ে তখন দেশজুড়ে হাহাকার ছিল। লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিদ্যুৎ কখন আসে সেটাই ছিল গবেষণার বিষয়। সেই আমলের শেষদিকে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন হয়। বিক্ষুব্ধ মানুষের ওপর পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাই বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ফল মেলে হাতে হাতে। ৫৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বাংলাদেশকে বর্তমান সরকার তুলে এনেছে ২২ হাজার মেগাওয়াটে। ক্যাপটিভ পাওয়ার ধরলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ভুলতে বসা লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি আবার ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। শুধু ফিরে এসেছে বললে ভুল হবে, দাপটের সঙ্গেই ফিরে এসেছে। বেপরোয়া লোডশেডিংয়ে এখন বিপর্যস্ত জনজীবন।

বিদ্যুতের সংকট শুরু হয় গত বছর জুলাই থেকে। সংকটটা আসলে অনুমিত এবং কিছুটা পরিকল্পিতও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর ডলারের পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া এবং জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশ টানে। চড়া দামে জ্বালানি কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে রিজার্ভে টান পড়ত। তাই সরকার পরিকল্পনা করেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে আনে। গত বছরের জুলাই মাসে পূর্বঘোষিত ও পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেওয়া হলেও সংকট তীব্র হওয়ায় তা আর রাখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতি রক্ষা করে সরকারকে। শীত এসে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট সহনীয় হয়। কিন্তু তখনই জানা ছিল, গরম এলে আবার বিদ্যুৎ সংকট প্রকট হবে। তবে যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, সংকট তার চেয়েও অনেক বেশি প্রকট হয়েছে। বিদ্যুতের ঘাটতি এখন ৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিরূপ প্রকৃতি। একদিকে বিদ্যুতের ঘাটতি বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম। ফলে অসহনীয় এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

অনেকে বলছেন, সরকার যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের উৎসব করল, তাহলে এত বিদ্যুৎ গেল কই? খুবই ন্যায্য প্রশ্ন। আসলে সংকট কিন্তু বিদ্যুতের নয়, সংকটটা ডলারের। জ্বালানি থাকলে চাহিদার পুরো বিদ্যুৎই উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে গেলে টান পড়বে পেটে পেটে। সমস্যাটা আসলে তৈরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে। হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, ডলারের পাগলা ঘোড়া হয়ে যাওয়া, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি—সব মিলে বিদ্যুৎ খাত এলোমেলো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা এখনো ক্যাপটিভসহ প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটেই আছে। চাইলেই সরকার ঘরে ঘরে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাদের অন্য অনেক জরুরি কাজে অর্থের টান পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমাতেই সরকার ইচ্ছা করে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটটি তাই ইচ্ছাকৃত, অনুমিত এবং পরিকল্পিত। সরকারকে ডলার বাঁচাতে জ্বালানি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে, তাতেই কমে গেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। এই যে প্রথমবারের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল, এটা কিন্তু কারিগরি ত্রুটির কারণে হয়নি। বন্ধ হয়েছে কয়লা আনার টাকা নেই বলে।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী যে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সংকট সহনীয় হওয়ার আশার বাণী শুনিয়েছেন, আমি কিন্তু ততটা আশাবাদী হতে পারছি না। বর্ষা এসে যদি তীব্র গরমটা একটু কমায় তাহলে পরিস্থিতি একটু সহনীয় হবে হয়তো। কিন্তু রাতারাতি উৎপাদন বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। বিদ্যুতের আসল সমস্যাটা হলো আমদানিনির্ভরতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল জ্বালানি—ডিজেল, এলএনজি, কয়লা; সবই আমদানি করতে হয়। জ্বালানির দেশীয় উৎসের জোগান বাড়াতে পারলে সংকট এতটা তীব্র হতো না।

এটা ঠিক বিদ্যুতের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে। লোডশেডিংয়ে আমরা শুধু নিজেদের ভোগান্তির কথাই ভাবি। ঘরে ঘরে লাইট-ফ্যান-এসির চেয়েও শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজনটা আরও বেশি। বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়, উন্নয়ন মন্থর হয়, অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে উন্নয়নকে মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আর সে কারণেই তাদের প্রথম নজর ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় গতি পায় উন্নয়নের চাকাও। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সরকার ব্যয়ের দিকে নজর দেয়নি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সরকার চড়া দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায়। ক্যাপাসিটি চার্জে চলে যায় হাজার কোটি টাকা। তাই উন্নয়নে গতি এলেও চড়া দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনীতিতে উল্টো চাপ তৈরি করে। আমাদের অর্থনীতি এগোচ্ছে। তবে অবস্থা এখনো পা ঢাকলে মাথা উদোম হয়ে যায়, মাথা ঢাকলে পা। যুদ্ধ বন্ধ না হলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থিতিশীল না হলে, জ্বালানি তেলের দাম না কমলে পরিস্থিতির টেকসই উন্নতি হবে না।

বিদ্যুৎ সংকটের প্রভাব সর্বব্যাপী ও দীর্ঘমেয়াদি। বিদ্যুৎ না থাকলে ঘরে ঘরে অন্ধকার, গরমের কষ্ট তো আছেই, কমবে শিল্প উৎপাদন, সেচ বিঘ্নিত হলে ফসল উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে। বিদ্যুতের সংকট ডেকে আনছে পানির সংকট। এমনকি লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিল্যান্সারদের আয়ও কমে যাচ্ছে। তাই একদিকে টাকা বাঁচাতে গিয়ে অন্যদিকে আয় কমে যাচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই সমাধানের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানির বিকল্প উৎসে মনোযোগ দিতে হবে। বিদ্যুৎ সংকটটা দারুণ একটা চক্রে আবদ্ধ। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গেলে রিজার্ভে টান পড়ে, আবার কমালে সার্বিক উৎপাদনে টান পড়ে। তবে আমরা এখন নগদ অর্থ বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাগাম টেনে ধরেছি। কিন্তু সেই লাগাম যদি শিল্প ও খাদ্য উৎপাদনেও টান লাগায় তখন দীর্ঘমেয়াদে সংকট ঘনীভূত হবে। ডিজেল কেনার টাকা নেই বলে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখছি বটে, কিন্তু লোডশেডিংয়ে জেনারেটর চালাতে ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে। আসলেই এ লাভক্ষতির ভারসাম্য বজায় রাখা সত্যি কঠিন। বিদ্যুৎ নিয়ে এই যখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা, তখন আইএমএফের শর্ত মেনে দফায় দফায় বাড়ছে বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুতের এ বাড়তি দাম মানুষের গাত্রদাহ আরও বাড়াচ্ছে শুধু।

তবে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল থাকলে সরকারকে গাল দিয়েও পরিস্থিতির বদল হবে না। আমাদের সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে মনোযোগ দিতে হবে, এমনকি পরিস্থিতির উন্নতি হলেও। বিদ্যুৎ অন্য সব পণ্যের মতো নয় যে আমি টাকা থাকলেই ইচ্ছামতো খরচ করব। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, আমার যত অর্থই থাকুক, আমি কিন্তু বিদ্যুৎ কিনছি উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে। গরিবের জন্য দেওয়া ভর্তুকির সুবিধা যেন বড়লোকরা নিতে না পারে, তার একটা উপায় বের করতে হবে। প্রয়োজনে অভিজাত এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের লিমিট ঠিক করে দিতে হবে বা যত বেশি ব্যবহার, তত চড়া দামের ব্যবস্থা করতে হবে। ভর্তুকির সুবিধাটা যেন গরিব মানুষ, শিল্প-কারখানা, সেচে যায়। চড়া মূল্যের বিদ্যুতে সারা দিন এসি চালিয়ে রাখা, অপ্রয়োজনে লাইট জ্বালিয়ে রাখা বা আলোকসজ্জার বিলাসিতা বন্ধ করতে হবে। বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট দেখে আমার লুডু খেলার কথা মনে পড়ে যায়। লুডু খেলায় ঘুঁটি নব্বইয়ের ঘরে গিয়েও সাপের মুখে পড়লে আবার দশের ঘরে নেমে আসতে পারে। বর্তমান সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নব্বইয়ের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎই যেন তা সাপের মুখে পড়েছে। এখন কীভাবে এ সংকট থেকে উতরানো সম্ভব তা নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাদকসেবন করে মাতলামি করায় যুবকের কারাদণ্ড

আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না: সুনীতা আহুজা 

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদমর্যাদাক্রম নিয়ে পরবর্তী আপিল শুনানি ৪ নভেম্বর 

শহিদের সঙ্গে প্রেম-বিচ্ছেদের কারণ জানালেন কারিনা

গাজায় তীব্র রূপ ধারণ করেছে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যু ৩১৩ জনের

রাজধানীতে লরির ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে গেল সিএনজি, নিহত ১

টিয়া পাখি নিয়ে ভিডিও করে বিপাকে শিক্ষিকা 

গ্রিন কার্ডের আবেদনে আসছে বড় পরিবর্তন

কেমন থাকবে আজকের ঢাকার আবহাওয়া

গাজাবাসীর জন্য রোজা থাকছেন বিশ্বের ১৫০ আলেম

১০

ডেনমার্ক দূতাবাসে চাকরির সুযোগ

১১

সকালে উঠেই কোন ভুলের কারণে বাড়ছে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি 

১২

গাজা সিটির নতুন এলাকায় ট্যাংক নিয়ে ঢুকেছে ইসরায়েলিরা

১৩

বেড়েছে স্বর্ণের দাম, আজ ভরিতে বিক্রি হচ্ছে কত টাকায়

১৪

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতায় কতটা অস্বস্তিতে ভারত?

১৫

সারা দেশে বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার ১৬৬২

১৬

নির্মাণাধীন নভোথিয়েটার ও বিটাক দখলে নিলেন ববি শিক্ষার্থীরা

১৭

আইভরি কোস্ট  / প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে চান ৬০ জন

১৮

রাজধানীতে আজ কোথায় কোন কর্মসূচি

১৯

গাজায় অবিলম্বে নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জাতিসংঘের

২০
X