মেজর (অব.) ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:৩৭ এএম
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি অপারেশন

মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি অপারেশন

শুরুর কথা: প্রাচীনকাল থেকেই কোনো কোনো স্থান, কাল ও পাত্রের পরিচয় বা সঠিকতা গোপন করতে সাংকেতিক নাম ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে এক শব্দবিশিষ্ট সাংকেতিক শব্দ (কোডওয়ার্ড) এবং দুই শব্দবিশিষ্ট ছদ্ম নামের (নিকনেম) ব্যবহার গোয়েন্দা কার্যক্রম ও যুদ্ধভিত্তিক নাটক, সিরিয়াল ও চলচিত্রেও পরিলক্ষিত হয়। এসব সাংকেতিক শব্দের প্রকৃত অর্থ শুধু সুনির্দিষ্ট এবং অনুমোদিত ব্যক্তিদেরই পূর্ব থেকে জানানো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘আমাদের জন্য সামনের মাসে কিছু মুড়ি, চিড়া ও পাটালিগুড় পাঠাবেন’—এমন একটি সরল বাক্যের অর্থ সাংকেতিক শব্দের কল্যাণে হতে পারে—‘আমাদের জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে অস্ত্রের গুলি (মুড়ি), গ্রেনেড (চিড়া) ও গাড়ির তেল (পাটালিগুড়) পাঠাবেন। আসন্ন আক্রমণের নাম হতে পারে ‘অপারেশন নৌকাবাইচ’। একটি শক্তিশালী শত্রু অবস্থান ‘বাঁশের কেল্লা’ আর নিজ অবস্থান ‘ফুলবাগান’ নামে পরিচিতি পেতে পারে। ‘কোবরা’ হতে পারে একটি বিশেষ টহল দলের বা কোনো দলনেতার ছদ্মনাম।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধজুড়ে অংশ নেওয়া উভয়পক্ষই অসংখ্য সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করেছে। তবে এর মধ্যে কিছু সাংকেতিক শব্দ নানা কারণে মানুষের মুখে মুখে ক্রমাগত উচ্চারিত হয় ও ইতিহাসের পাতায় বারবার ফিরে আসে।

অপারেশন সার্চলাইট: পৃথিবীর ইতিহাসে ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলোতে আওয়ামী লীগের নেতা, সমর্থক ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার, সামরিক অভিযান চালিয়ে দেশব্যাপী চলা অসহযোগ আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এ অপারেশনের উদ্দেশ্য। মার্চ মাসজুড়ে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করলেও তা ব্যর্থ হয়। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি অধিকারের লড়াইয়ে জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুরো দেশ চলতে থাকে। এদিকে অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করতে তথা গণহত্যার প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য মার্চের ২৪ তারিখে ইয়াহিয়া খান টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলিকে নির্দেশ প্রদান করেন। ২৫ মার্চ দুপুরে কুখ্যাত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তার অধীন মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইনকে ফোন করে বলেন, ‘খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা।’ ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই কারফিউ জারি করে প্রস্তুতি শুরু করা হয় পাশবিক তাণ্ডব চালানোর। ১১টা ৩০ মিনিটে পাকিস্তানি সেনারা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ফার্মগেটে মিছিলরত বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের সূচনা করে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস সদর দপ্তরসহ পুরো ঢাকাকে মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত করে। এরপর গণহত্যা চলতে থাকে শহর পেরিয়ে গ্রামগঞ্জে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পৃথিবীর ইতিহাসে নিন্দনীয় হয়ে আছে অপারেশন সার্চলাইট নামের নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ। (তথ্যসূত্র : রিদ্মিক নিউজ ২৩ মার্চ ২০২৩ ‘অপারেশন সার্চলাইট: জানা-অজানার এক ইতিহাস’; তানভীর মাহাতাব আবির)।

অপারেশন জ্যাকপট: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাঞ্চলকে যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, এর মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ-কমান্ডো দল। ১৯৭০ সালে ফ্রান্স থেকে একটি সাবমেরিন কেনে পাকিস্তান নৌবাহিনী। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য নভেম্বর মাসে ৫৭ জন পাকিস্তানি নৌ-সেনাকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়, যাদের ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে তারা ফ্রান্সের ঘাঁটি থেকে পালিয়ে প্যারিসগামী ট্রেনে ওঠে স্পেনের লিওঁ-বার্সেলোনা-মাদ্রিদ, ইতালির রোম ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা হয়ে ৯ এপ্রিল দিল্লিতে পৌঁছান। তখন এই নৌ কমান্ডো সেক্টর গঠিত হয়। ভারতের নদীয়া জেলার ঐতিহাসিক পলাশী গ্রাম এবং তৎসংলগ্ন ভাগীরথী নদীর তীরে তাদের স্থলযুদ্ধ ও জলযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সেখানে তাদের শীত ও বর্ষায় একটানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করানো হয়েছিল। সব মিলিয়ে তাদের দৈনন্দিন ১৬-১৭ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ নিতে হতো। প্রায় টানা তিন মাস কঠোর প্রশিক্ষণ হয় নৌ কমান্ডোদের এবং তাদের নিয়েই পরিকল্পনা করা হয় নৌ কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’।

দুটি সমুদ্রবন্দর ও দুটি নদীবন্দরে আক্রমণ চালানোর জন্য চারটি দলে ভাগ করা হয় নৌ কমান্ডোদের। ৬০ জনের দুটি দল এবং ২০ জনের আরও দুটি দল। মূলত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে অপারেশন জ্যাকপটের দিন নির্ধারণ করা হয় ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে (১৫ আগস্ট রাত ১২টায়)। নির্দিষ্ট সময়ে সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জন নৌ কমান্ডো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে, আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ২৬০ জন কমান্ডো (যার মধ্যে ৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন সিআন্ডসি কমান্ডো) মোংলা সমুদ্রবন্দরে, সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে ২০ জন কমান্ডো চাঁদপুর নদীবন্দর ও সাবমেরিনার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জন কমান্ডো নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর আক্রমণ করে। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘এমভি হরমুজ’ ও ‘এমভি আল-আব্বাস’ নামে দুটি পাকিস্তানি জাহাজসহ বেশ কয়েকটি বার্জ ও জাহাজ ধ্বংস হয়। এমভি হরমুজে ৯৯১০ টন ও এমভি আল-আব্বাসে ১০ হাজার ৪১৮ টন সমর সরঞ্জাম ছিল। সাবমেরিনার আহসানউল্লাহর (বীরপ্রতীক) নেতৃত্বে ৪৮ জন নৌ কমান্ডো মোংলা বন্দরে অভিযান করেন। বন্দরের ছয়টি জাহাজ মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। একই সময়ে সাবমেরিনার বদিউল আলমের (বীরউত্তম) নেতৃত্বে ২০ জন নৌ কমান্ডো চাঁদপুর বন্দরে মাইন দ্বারা কয়েকটি জাহাজ ধ্বংস করেন। সাবমেরিনার আবদুর রহমান (বীরবিক্রম) ও শাহজাহান সিদ্দিকের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বে ২০ জনের কমান্ডো দলও নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নদীবন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করেন। অপারেশন জ্যাকপট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নৌ কমান্ডোরা অল্প সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিমত্তা, দক্ষতা, মনোবল, দেশপ্রেম ও যুদ্ধের গতি সম্পর্কে বিশ্বকে ধারণা দিতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী চতুর্থ কোর পরিচালিত অভিযানও (২১ নভেম্বর-১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে পরিচিত হতে পায়। (তথ্যসূত্র : দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ আগস্ট ২০২৩ এবং উইকিপিডিয়া)

ক্র্যাক প্লাটুন: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুন মাসের ৭, ৮ ও ৯ তারিখে ঢাকায় পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টিম আসবে বলে খবর রটে। তাদের দেখানো হবে ঢাকাসহ সারা দেশে যুদ্ধের কোনো লেশমাত্র নেই। তখন ফাইভস্টার হোটেল একটাই— হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। সেখানেই তারা থাকবে। মুক্তিযোদ্ধাদের মিশন নিয়ে কে ফোর্স কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বললেন, বিশেষ একটি দলের কাজ হবে ঢাকা থেকে দূরে, রাতে নিরাপদ জায়গায় থেকে রাত ৮টার পরে প্রতিদিন ২টা-৪টা করে গ্রেনেড ফাটানো। রাতে যদি ধুমধাম করে গ্রেনেড ফাটে তাহলে ইন্টারকন্টিনেন্টালে আওয়াজটা যাবে এবং বিশ্ব জানবে ঢাকায়ও যুদ্ধ চলছে। আদেশ নিয়ে ৪ জুন রাতে আগরতলা থেকে ১৭ জনের দল ঢাকায় চলে আসে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে। পরদিন ৫ জুন সকালে স্টেডিয়ামের পূর্বদিকে আল ইসলামিয়া হোটেলে একত্রিত হয় ১১ জন এবং পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। নির্দিষ্ট সময়ে তারা গেট দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরে ঢুকে ও সব বিদেশি আর পাকিস্তান আর্মির লোকজন দেখতে পায়। তারা তিনটি কোক আর স্যান্ডউইচের অর্ডার করে বসে দেখছিল কী হচ্ছে। এভাবেই শেষ হয় রেকি বা পর্যবেক্ষণ পর্ব।

৯ জুন সন্ধ্যার পর একটা গাড়ি জোগাড় করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে পৌঁছে দলটি। হোটেলের সামনে তখন অনেকগুলো মোটা মোটা কড়ইগাছ ছিল। বিদেশিদের পুরো শহর দেখিয়ে পাকিস্তানি আর্মির দলটি হোটেল পৌঁছানোর পরপরই মুক্তিযোদ্ধা মায়া আর আলম পিন খুলে চারটি গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। একটা গিয়ে একজনের পায়ে লেগে থেমে গেল আর একটা সোজা চলে গেল ভেতরে। ২-৩ সেকেন্ডের মধ্যে আরও দুটি গ্রেনেড ছুড়ল তারা। গ্রেনেড থেকে যখন ধোঁয়া উড়তে শুরু করল, আতঙ্কে সবাই একসঙ্গে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা চালাল। কিন্তু দরজা তো রিভলভিং, তাই কেউই আর যেতে পারছিল না। এর মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা লাফ দিয়ে গাড়িতে ওঠেন আর সঙ্গে সঙ্গে পরপর চারটি বিস্ফোরণ ঘটে। সবার ছোটাছুটি আর চিৎকার শুনতে শুনতে দলটি একটানে মগবাজার পৌঁছে। সেখানে মুসলিম লীগের মিটিংয়ে আরও দুটি গ্রেনেড মারা হয়। সেখান থেকে দৈনিক বাংলা পত্রিকা অফিসের ভেতর আরও দুটি গ্রেনেড ছোড়া হয়। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিশ্ব মিডিয়া এ খবর প্রচার করে এবং পুরো ইন্টারকন্টিনেন্টাল ফাঁকা হয়ে যায়। ওই রাতেই সবাই যার যার দেশে চলে যায়। এটিই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম হিট অ্যান্ড রান অপারেশন। পরে এরকম আরও ৬০-৭০টি অপারেশন হয়েছে।

এ অপারেশনের পরদিন ৯ জুন বাকি গ্রেনেডগুলোও বিভিন্ন জায়গার মেরে আগরতলা ফিরে যান মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের দেখেই খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারকে বললেন—লুক হায়দার লুক, এদের আমরা বললাম, দূরে দূরে গ্রেনেড ফাটাতে। আর এরা ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢুকে ব্লাস্ট করে দিল! হাউ ডেয়ার, দে আর অল ক্র্যাক। ক্র্যাক না হলে কি আর এরকম করতে পারে! এরপর ক্র্যাক নামটা পুরো ক্যাম্পেই ছড়িয়ে গেল। আর অপারেশন পরিচালনাকারী ৩ নম্বর প্লাটুনই হয়ে গেল ক্র্যাক প্লাটুন। (তথ্যসূত্র: নিউজ বাংলা ২৪ ডট কম, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০)

অপারেশন ক্যাকটাস লিলি: মুক্তিযুদ্ধের এক ক্রান্তিকালে ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনী সে দেশের সেনাবাহিনীর চতুর্থ কোর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হেলিকপ্টারে মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নরসিংদীর রায়পুরা পর্যন্ত পরিবহন করে। স্থলপথে আশুগঞ্জে ধ্বংস হওয়া মেঘনা সেতু এবং পাকিস্তানি প্রতিরক্ষাকে মোকাবিলা না করে ‘অপারেশন ক্যাকটাস লিলি’ নামক এ অভিযান পাকিস্তানিদের অপ্রস্তুত করে ও বেকায়দায় ফেলে দেয়। ফলে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।

ঢাকা দখলের অভিযানের শুরুতে ঢাকাকে দ্বিতীয় কোরের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয় এবং চতুর্থ কোরকে কুমিল্লার দুর্গ দখল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পতন ও মেঘনা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পর চতুর্থ কোরের পক্ষে নদী পার হওয়ার একমাত্র পথ ছিল আশুগঞ্জ সেতু, পাকিস্তানিরা সুরক্ষিত রেখেছিল। এ সময় আকাশ থেকে নেওয়া ছবিতে দেখা যায় যে, আশুগঞ্জ সেতুটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তখন চতুর্থ কোরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাগত সিং ভারতীয় সৈন্যদের আকাশপথে নদীর অন্য পাড়ে রায়পুরায় পাঠানোর এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। সেই মোতাবেক ৯ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এমআই হেলিকপ্টারগুলো পুরো ৩১১ ব্রিগেডকে (পর্যায়ে ৫০০০ সৈন্য) পারাপার শুরু করে। ৬০০ জনের প্রথম সৈন্য দল ৯ তারিখ রাতে রায়পুরার উত্তরে অবতরণ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করে। ভারতীয় জঙ্গি বিমানও তখন পাকিস্তানিদের ওপর বোমাবর্ষণ করতে থাকে। এই অভিযান চলার সময়ই ৭৩তম ব্রিগেড নৌকা ও নদীপথে বিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে মেঘনা নদী পার হয়ে যায়। পাকিস্তানিদের হটিয়ে ও নরসিংদীকে সুরক্ষিত করার পর ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তা নিয়ে মিত্র বাহিনী ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর দাউদকান্দি ও বাইদ্দার বাজার দখল করে। ততক্ষণে পাকিস্তানিরা ঢাকায় আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। অপারেশন ক্যাকটাস লিলির ঘটনার ওপর ভিত্তি করে পরিচালক চেতন আনন্দ ‘হিন্দুস্তান কি কসম’ নামে একটি হিন্দি ছবি নির্মাণ করেন, যা ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়। (তথ্যসূত্র: ভারতপিডিয়া)।

অপারেশন ঢাকা বোল (Dhaka Bowl): সামরিক মূল্যায়নে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ‘ডিফেন্ডারস প্যারাডাইস’ বা প্রতিরক্ষাকারীর স্বর্গ বলা হয়। কারণ দেশের যে কোনো দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হলে একাধিক খাল-নদী-নালা ও জলাশয় অতিক্রম করতে হয়, যার তীর ঘেঁষে আক্রমণকারীকে ঘায়েল করার যাবতীয় আয়োজন করে প্রতিরক্ষাকারীরা। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মতো বড় তিনটি নদী অতিক্রম না করে দেশের পূর্ব, পশ্চিম বা দক্ষিণ দিক থেকে কোনো শক্তি স্থলপথে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। আর ঢাকার প্রতিরক্ষা প্রাকৃতিকভাবে আরও নিশ্চিত করেছে জেলার চারপাশে গলার মালার মতো লেগে থাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী। মুক্তিযুদ্ধকালে নদীবেষ্টিত ঢাকাকে ‘ঢাকা বোল’ (Dhaka Bowl) ছদ্মনাম দিয়ে যে কোনো মূল্যে তা সুরক্ষার আয়োজন করে পাকিস্তানি সেনারা। আর মিত্র বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নেওয়া শত্রু অবস্থানকে প্রয়োজনে ফেলে রেখে বা বাইপাস করে দ্রুততম সময়ে ‘ঢাকা বোলের’ নিকটবর্তী হওয়া এবং যে সেনাবহর সবার আগে ‘ঢাকা বোলের’ কাছে পৌঁছবে, তাদের দিয়েই ঢাকার পতন ঘটানো। এ ক্ষেত্রে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার ১০১ কমিউনিকেশন জোন সবার আগে আমিনবাজারে তুরাগ নদীর তীরে পৌঁছে এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বিজয় নিশ্চিত করে।

লেখক: গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাকিস্তানে কোন কোন অস্ত্র ব্যবহার করেছে ভারত

সীমান্তে পাকিস্তান-ভারত গোলাগুলি চলছে

মহাসড়কে ঝুমকার মতো ঝুলছে সোনালু ফুল

পলাতক, পদত্যাগ, বরখাস্ত ও অনুপস্থিত শিক্ষকদের তথ্য তলব

পাকিস্তানে হামলাকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ বলছে কেন ভারত?

পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াল শক্তিশালী এক মুসলিম দেশ

পাকিস্তানে হামলার পর ভারতীয় রুপির পতন

পাঞ্জাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, স্বাস্থ্যকর্মীদের ছুটি বাতিল

পাকিস্তান সেনাদের হামলায় তিন ভারতীয় নিহত

পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরে এয়ার ইমার্জেন্সি জারি

১০

১৯৭১ সালের পর প্রথমবার এমন হামলা চালিয়েছে ভারত

১১

এক রাতে ৩ রাফায়েল খোয়াল ভারত

১২

ভারতের সঙ্গে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ শেহবাজ শরিফের

১৩

বায়ুদূষণে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ঢাকা

১৪

০৭ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

পাকিস্তানে হামলা চালাতে গিয়ে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে ভারত

১৬

পাকিস্তানের পাল্টা হামলা, ভারতের একাধিক বিমানবন্দর বন্ধ

১৭

পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে ফোন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

১৮

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

১৯

০৭ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

২০
X