প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০২:৪৫ এএম
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপির ভুল বিএনপির শিক্ষা

বিএনপির ভুল বিএনপির শিক্ষা

বাংলাদেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। গত বছরের জুলাই থেকে তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে তারা সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দেয়। বিএনপির আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। গণতান্ত্রিক দেশে যে কোনো দল যৌক্তিক-অযৌক্তিক যে কোনো দাবি করতে পারে। সে দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনও করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপির সব আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দাবির পক্ষে জনগণকে মাঠে নামাতে পারেনি তারা। নিশ্চয়ই বিএনপি তাদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করবে। নতুন করে আন্দোলনে নামবে। সামনে এগিয়ে যেতে হলে ঠিকঠাকমতো ভুল চিহ্নিত করতে পারা এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে পারাটা জরুরি।

সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান সম্প্রতি এক টক শোতে বিএনপির আন্দোলনের ভুল সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন করেছেন। সেটা অনেকটা বাস্তবতার কাছাকাছি। তিনি বলেছেন, পাঁচজন কূটনীতিক, সুশীল সমাজের পাঁচজন সদস্য এবং দেশের বাইরে থাকা পাঁচজন ইউটিউবার—এই ১৫ জন মিলে বিএনপির আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে। আমি তার এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত। আন্দোলন সফল করার ব্যাপারে বিএনপি জনগণের ওপর ভরসা করেনি। তাদের ধারণা ছিল, বিদেশিরা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা চাপ দিয়ে সরকারের পতন ঘটিয়ে দেবে। আর তারা আরামসে ক্ষমতায় চলে আসবে। বিএনপি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, এমনকি পদত্যাগ ছাড়া অন্য কোনো শর্তে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতেও রাজি ছিল না। আর তাদের এই আত্মবিশ্বাসের উৎস ছিল সুশীল সমাজ এবং প্রবাসী ইউটিউবাররা। বিশেষ করে ইউটিউবাররা প্রায় বছরজুড়ে সরকার পতনের দিন তারিখ ঘোষণা করে আসছিল। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকেই সরকার পতনের ডেটলাইন শুরু হয়েছে। দেশে বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে, যে কোনো সময় লাখ লাখ মানুষ মাঠে নেমে আসবে, প্রশাসন বিদ্রোহ করবে—এমন উদ্ভট সব ঘোষণা দিয়ে তারা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করেছে দিনের পর দিন। আর বিএনপি পড়েছে ফাঁপা আত্মবিশ্বাসের ফাঁদে। দায় আছে বিএনপির নেতৃত্বেরও। বিএনপি এখন কার্যত ভার্চুয়াল রাজনৈতিক দল। লন্ডন থেকে কর্মসূচি আসে। কিন্তু এমন কর্মসূচি আসে, যা পালিত হয় না। লন্ডনে বসে যিনি কর্মসূচি দেন, তিনি ১৬ বছর ধরে দেশের বাইরে। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, রাজপথের অবস্থা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। ফলে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করে ক্ষমতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে এমনসব কর্মসূচি দেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই।

২০২২ সালে এবং ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপি বেশকিছু জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করে। বিভাগীয় পর্যায়ে তাদের মহাসমাবেশে বিপুল লোকসমাগম হয়। তাতে দেশজুড়ে বিশাল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা পাল্টে দেয় সবকিছু। যখন বিএনপির আন্দোলন তুঙ্গে থাকার কথা, তখন পুরো দল আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। রুহুল কবির রিজভি গোপন জায়গা থেকে ভিডিওতে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি দিতেন। কিন্তু কেউ তাতে পাত্তাও দিত না। এরপর বিএনপি মাঠে নামাল অগ্নিসন্ত্রাসীদের। তারা ট্রেনে-বাসে আগুন দিল, তাতে কয়েকজন নির্দোষ মানুষ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। কিন্তু তাতে সরকারকে টলানো গেল না। এরপর লন্ডন থেকে এলো সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক। এমন হাস্যকর কর্মসূচি বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে নেই। তারেক রহমানের এই অসহযোগের ডাকে একজন মানুষও সাড়া দেয়নি। এমনকি বিএনপির নেতাকর্মীরাও কেউ তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ না করে বসে থাকেনি। সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি দেখে মনে হয়েছে, এ কর্মসূচি লন্ডন থেকে নয়, মঙ্গলগ্রহ থেকে এসেছে। মজার কথা হলো, সর্বাত্মক অসহযোগের কিন্তু সময়সীমা ছিল না। তার মানে এখনো বিএনপির ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ চলছে। এর আগে খালেদা জিয়ার ডাকা অসহযোগ কর্মসূচিও এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। দেশের মানুষ এসব কর্মসূচি দৃশ্যত প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বিরক্ত। কিন্তু তারচেয়ে বেশি বিরক্ত বিএনপির ওপর। বিএনপি যে আওয়ামী লীগের বিকল্প নয়, এটা বিএনপি বারবার প্রমাণ করেছে।

অনেকদিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলেও বিএনপিকে এখনো বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ পছন্দ করে। কিন্তু আমার বিবেচনায় বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সেই সমর্থনকে সম্মান না করা, তাদের সংগঠিত করতে না পারা। বিএনপির চূড়ান্ত কর্মসূচি দেখে একবারও মনে হয়নি তারা জনগণের কথা ভাবছে। নামকাওয়াস্তে কর্মসূচি দিয়ে তারা অপেক্ষা করেছে গায়েবি শক্তির জন্য। কিন্তু বিদেশি শক্তিগুলো বিএনপিকে গাছে উঠিয়ে মই সরিয়ে নিয়েছে। একে একে সবাই এখন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করছে। বিএনপি এবারের নির্বাচনে যায়নি। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেও তারা বলেছে, নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর তাদের ধারণা ছিল, সরকার গঠন করতে পারবে না। তাদের আশা ছিল, বিদেশিরা নানা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সরকারকে কাবু করে দেবে। কিন্তু সবাই গরলি ভেল। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ফেলেছে। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন নিয়েই তারা নতুন উদ্যমে কাজে নেমেছে। কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাই সত্যি হয়নি।

সামনে আসছে উপজেলা নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচন উন্মুক্ত রেখে আওয়ামী লীগ আবার দেশে নির্বাচনী হাওয়া তুলবে। বিএনপি যদি আবারও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, তারা আরও জনবিচ্ছিন্ন হবে, আরও পিছিয়ে পড়বে। বিএনপি একটি ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক দল। প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি কতদিন তাদের জনসমর্থন ধরে রাখতে পারবে, কতদিন নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।

বিএনপির এখন উচিত সব কর্মসূচি ভুলে নিজেরা বসে নিজেদের অতীতের ভুলগুলো চিহ্নিত করা। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া। তাদের প্রথম কাজ হবে, আইনি প্রক্রিয়ায় নেতাকর্মীদের মুক্তি ত্বরান্বিত করা। তারপর জনগণকে মাথায় রেখে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন করা। বিদেশি শক্তি, সুশীল সমাজ আর ইউটিউবারদের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করা। তারচেয়ে বড় কথা হলো, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করা। জয়ের নিশ্চয়তা নেই, এটা জেনেও তাদের নির্বাচনে যেতে হবে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে না গেলে আজকের আওয়ামী লীগকে খুঁজে পাওয়া যেত না। ’৭৫-এর পর চরম দুঃসময়েও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে গিয়েছিল এবং ৩৯টি আসন পেয়েছিল। আগামী উপজেলা নির্বাচনই হতে পারে বিএনপির জন্য একটা সুযোগ। বিএনপির মতো দলের জন্য জনগণের কাছে যেতে নির্বাচনের চেয়ে ভালো আর কোনো পথ নেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিদেশিদের যে নৈতিক সমর্থন পেয়েছিল বিএনপি, তার সঙ্গে যদি স্থানীয় জনসমর্থনের যোগসূত্র ঘটাতে পারত, তাহলে ক্ষমতায় না গেলেও নির্বাচনে ভালো করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল তাদের সামনে। কিন্তু শুরুতে যেমনটি বলছিলাম, ১৫ জনের পাল্লায় পড়ে তারা যেন নিজেরাই নিজেদের ওভার এস্টিমেট না করেন। বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কর্মসূচি নিতে হবে। সহিংসতা ছাড়তে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ছাড়তে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নইলে বিএনপি এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতেই অপাঙক্তেয় হয়ে যেতে পারে। তাতে বিএনপির যেমন ক্ষতি, তারচেয়ে বড় ক্ষতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির। গণতন্ত্রের স্বার্থেই সংসদের ভেতরে-বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। বিএনপি ব্যর্থ হলে বিরোধী দলের শূন্যতা পূরণ করতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাইপলাইনে গ্যাস, ১০ বছরেও আবেদন করেনি কেউ!

নারায়ণগঞ্জে নারী কাউন্সিলর লাঞ্ছিত, অতঃপর...

রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে বিএসপিএ স্পোর্টস কার্নিভাল

জামায়াতকে একমঞ্চে চায় ১২ দলীয় জোট

সৈয়দপুরে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ

মেক্সিকোতে শক্তিশালী ভূমিকম্প, ধ্বসে পড়েছে রাস্তাঘাট

‘সরকার দুর্নীতি দমন না করে বিএনপি দমনে ব্যস্ত’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে প্রণয় ভার্মার সাক্ষাৎ

ইউএস ট্রেড শো ২০২৪ / সেরা প্যাভিলিয়নের পুরস্কার জিতে শেষটা রাঙিয়ে তুলল রিমার্ক-হারল্যান

১০

সোমবার রাতে কুতুবদিয়ায় পৌঁছবে এমভি আব্দুল্লাহ

১১

জিপিএ-৫ পেল মেয়ে, দুশ্চিন্তায় রিকশাচালক পিতা

১২

মুখস্থ শিক্ষার ওপর নির্ভরতা কমাতে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

১৩

রাশিয়ায় ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, নিহত ৭

১৪

বহুমুখী শিক্ষায় সীমাখালী ইসলামিয়া আইডিয়ালের ঈর্ষণীয় সাফল্য

১৫

অংকে ফেল করায় গলায় ফাঁস নিল কিশোরী

১৬

ইসরায়েলে পুলিশ-জনগণ সংঘর্ষ, ভয়ংকর বিপদে নেতানিয়াহু

১৭

পা দিয়ে লিখেই এসএসসি পাস করল সিয়াম

১৮

দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ

১৯

গ্রিন রোড থেকে রিকশার গ্যারেজ উচ্ছেদ, যান চলাচলে ফিরেছে স্বাচ্ছন্দ্য

২০
X