সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:০২ এএম
আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মোমেন থেকে ড. হাছানের কূটনীতি কতটা ভিন্ন হবে

মোমেন থেকে ড. হাছানের কূটনীতি কতটা ভিন্ন হবে

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সম্প্রতি এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বসেছিলেন টেলিভিশন সংবাদ বিভাগের প্রধান ও সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতারা। অনানুষ্ঠানিক হলেও নতুন সরকারের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ বা ইস্যুগুলো আলোচনায় এসেছিল। বলেছেন, কূটনৈতিক ইস্যুগুলো নতুন প্রেক্ষাপটে দেখার চেষ্টা করছেন তিনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বাস্তবধর্মী পথ খোঁজা তার কাছে অগ্রাধিকার।

প্রথম সরকারি সফরটি হচ্ছে ভারতে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের আমন্ত্রণে এর মধ্যেই তিনি নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন এবং আমরা যখন কথা বলছিলাম সেদিনই বাংলাদেশের বড় আলোচনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠি। বললেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। এ চিঠির মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নত হবে, নতুন উচ্চমাত্রা পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চিঠিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানিসহ নানা বিষয়ে একযোগে কাজ চালিয়ে যেতে তার প্রশাসনের আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

প্রশ্ন হলো, বাইডেনের এ চিঠি কী বার্তা দেয় বাংলাদেশের জন্য। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত বাংলাদেশে সম্প্রতি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ চিঠি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি এখন কী বলবে? বলেছেন, যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বেশি ভরসা ছিল সেই যুক্তরাষ্ট্রও শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে।

এই যে একটা সৌজন্য চিঠির রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তা শুধু বাংলাদেশেই হয়তো সম্ভব। বিএনপির সঙ্গে মাঠে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠি পাঠানো নিয়ে উচ্ছ্বসিত না হতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন।

কিন্তু এ চিঠি কি বিএনপিসহ তার মিত্রদের কোনো উৎসাহ জোগায়? হ্যাঁ, সরাসরি অভিনন্দন না জানিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আরও বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে তাগিদ দিয়েছেন জো বাইডেন।

নির্বাচনের আগে বিএনপি এমন একটা ভাব করেছিল যে, আমেরিকান সরকার একটা কিছু করবে, নির্বাচন হতে পারবে না। নির্বাচন যখন নিশ্চিত তখন বলতে শুরু করল যে, নির্বাচনের পর স্যাংশন আসবে। তো নির্বাচন হয়ে গেল, সরকার গঠিত হলো, সংসদ অধিবেশনও শুরু হলো। কিন্তু স্যাংশনের দেখা নেই। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস এখন মেপে মেপে কথা বলছেন আর বাইডেন তো চিঠিই দিলেন।

এ চিঠির তাৎপর্য কী? যুক্তরাষ্ট্র জানে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম তারই স্বীকৃতি জো বাইডেনের এ চিঠি। আসলে এ অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে বড় লক্ষ্য আছে, এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশকে দরকার। বাংলাদেশে এমন একটা সরকার দরকার, যার একটা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্ত অবস্থান আছে। শেখ হাসিনাকে সেই জায়গা থেকেই এখন বিচার করছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ চিঠিতে সহযোগিতার কথা বলা হলেও অভিনন্দন না জানানো কূটনীতিক দৃষ্টিতে কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মীই বলা চলে। বোঝা যায় রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় এখনো কিছুটা হলেও ঘাটতি আছে আর সেই ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগও এ চিঠিই।

বাংলাদেশের আরও অনেক ক্ষেত্রে বোঝাপড়া আছে। বিশেষ করে বিএনপি যেভাবে গত দুটি বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিকে সরগরম করে রেখেছিল, তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। নিয়মিতভাবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রিফিংয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে উত্তর আদায় করা হয়েছে। দেশের ভেতরেও দলটি কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা কোনোভাবেই কূটনীতিকসুলভ মনে হয়নি।

বিএনপির বাইরে কিছু এনজিও, সংবাদমাধ্যম এবং ব্যক্তিবিশেষও কূটনীতিকদের, বিশেষ করে মার্কিন দূতকে ডেকে এনে তার মুখ দিয়ে কথা বলিয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই ছিল সরকারবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতি এবং ২০২১ সালে ঘোষিত র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার এমন ভীতিকর প্রচার এরা করেছে যে, মনে হচ্ছিল সরকার নির্বাচন করতেই পারবে না। সবাই তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নানা প্রকার নালিশও করেছে। পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলী কৌর বাংলাদেশে এসে নির্বাচন নিয়ে কথা বলে গেছেন। এসেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলও। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে চীন ও রাশিয়াও।

একদিকে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক উত্তাপ, নির্বাচন ঘিরে বিদেশি তৎপরতায় মনে হচ্ছিল সংকট

একেবার ঘনীভূত, নির্বাচনই অনিশ্চিত। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচন করেছেন। আমরা সবাই বলি সংঘাতের মাধ্যমে কোনো সমাধান আসে না। কিন্তু এ নির্বাচন নিয়ে সংঘাত, মৃত্যু, আগুন সন্ত্রাস সবই হয়েছে।

এরই মধ্যে অভিনন্দন বার্তা আসছে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে। সব বার্তাই এমন যে, তারা আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ইস্যু অনেক আছে, রাজনীতি যেমন আছে, তেমনি আছে বাণিজ্য সহযোগিতা, জলবায়ু এবং রোহিঙ্গা সমস্যা। বাংলাদেশ ছোট দেশ, কিন্তু বাংলাদেশকে প্রয়োজন বড় দেশের। একটি বিকাশমান অর্থনীতি, ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয়তার কারণে বাংলাদেশকে তাদের দরকার।

শেখ হাসিনা অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। বাংলাদেশের কূটনৈতিক চাওয়াটা সেখানেই। সেজন্য সরকারকে দলীয় রাজনীতি নয়, তার ওপরে উঠে দীর্ঘমেয়াদি পথ খোঁজা।

পরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ড. হাছান মাহমুদের এজেন্ডাও তাই। দায়িত্ব গ্রহণের একদম শুরুতে বলেছিলেন, নানারকমের চাপ উতরে নির্বাচন হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব বোঝাপড়া থেকে বক্তব্য দিয়েছে; উন্নয়ন সহযোগীদের কোনো উদ্বেগ থাকলে সরকার সেগুলোকে গুরুত্ব দেবে। বলেছিলেন, আমরা মনে করি, বিভিন্ন দেশের নানা পারসেপশন, নানা ন্যারেটিভ থাকে, আমরা সেগুলোকে ভ্যালু করি, তবে আমরা সবার সঙ্গে একযোগে কাজ করব। দিনশেষে সবাই আমরা একযোগে কাজ করব।

নির্বাচন প্রশ্নে ভারত, চীন ও রাশিয়া দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে সরকারকে। ফলে এ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ স্বভাবতই থাকবে। তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা এবং অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা চলমান থাকবে।

নির্বাচনের আগে দেশের ভেতর থেকে সাবেক কূটনীতিকদের অনেকেই বলছিলেন, নির্বাচন তো যা হওয়ার তা হয়ে যাবে, কিন্তু সে নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে পশ্চিমা দুনিয়ায়? তো নির্বাচনের পর এখন আর সে প্রশ্ন উঠছে না। বরং মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক আদানপ্রদান এবং সহযোগিতার পথটাই

জারি থাকছে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল

মোমেনের বচন নিয়ে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকে ড. হাছানের কূটনীতির ভিন্নতার অপেক্ষায় জাতি।

বাইডেনের চিঠির প্রসঙ্গটা আবার করতে হয়। নির্বাচন সামনে রেখে বলা হচ্ছিল নির্বাচন হলে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে। সেসব ধরন নিয়ে অনেক কথাও বলা হচ্ছিল। দেখা গেল ভিসা নিষেধাজ্ঞার কোনো ভয় সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনীতিবিদরা পাননি। তারা তাদের স্বাভাবিক কাজ করেছেন। অর্থনৈতিক স্যাংশনও দৃশ্যমান নয় এবং সেটা আসার সুযোগও দেখা যাচ্ছে না। এর অর্থ হলো, অর্থনীতিতে বড় কোনো সংকট সৃষ্টি হচ্ছে না এসব স্যাংশন ঘিরে। কোনো ধরনের আর্থিক বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞারও সম্ভাবনা নেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতিকে আমাদেরই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে। সেটাই বিদেশিদের কাছে নিজস্ব শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নরসিংদীতে বিয়ের অনুষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগ, টেঁটাবিদ্ধসহ আহত ২০

ঝালকাঠিতে পথসভায় হামলা, চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ আহত ২০

পরিত্যক্ত সবজি থেকে পলিথিন, কলাগাছের তন্তু থেকে প্লাস্টিক তৈরি

ঢাকায় প্রথম দিনে ব্যস্ত সময় কাটালেন ডোনাল্ড লু

‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে’

পথচারীদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় সোনালু ফুল

প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে পোস্ট, অতঃপর...

চবি আইইআর ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি কাওসার, সম্পাদক মিমি

চাল বিতরণে অনিয়ম, ইউপি সদস্য বরখাস্ত 

কয়রার বাগালী ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত বাজেট সভা

১০

ভিডিও দেখে আঙ্গুর চাষে সফল আনোয়ার

১১

ব্যাংক ১ টাকা দিয়ে ১০ টাকার জমি নিতে চায় : রাফসান

১২

অনিয়মের বেড়াজালে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

১৩

তুরস্কে চিকিৎসা নিচ্ছে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা: এরদোয়ান

১৪

গতিসীমার মধ্যে থেকেও ওভারটেকিংয়ের পথ দেখালেন ডিএমপি কমিশনার

১৫

বিপ্লবের পরিবারে যেন ঈদ আনন্দ

১৬

বাংলাদেশের ফুচকা বেস্ট : ডোনাল্ড লু

১৭

গুজব প্রতিরোধে সচেতনতা দরকার: পিআইবি মহাপরিচালক

১৮

বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করল একাধিক এয়ারলাইন্স

১৯

প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে ছাত্রলীগের কর্মসূচি ঘোষণা

২০
X