প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫১ এএম
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯:১১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারের ভুল, সরকারের শিক্ষা

সরকারের ভুল, সরকারের শিক্ষা

ক্ষমতায় থাকার একটা নেতিবাচকতা আছে। অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি যে কোনো সরকারকে মেয়াদ শেষে অজনপ্রিয় করে দেয়। এ প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই ক্ষমতাসীনরা দ্রুত অজনপ্রিয় হন। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ’৯১ সালে গণতন্ত্রের নবযাত্রায় ক্ষমতায় আসে। এরপর একবার বিএনপি, একবার আওয়ামী লীগ—এভাবেই চলছিল ক্ষমতার পালাবদল। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে এ ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটে। ২০০৮ সালের পর থেকেই ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। বর্তমানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার টানা চতুর্থ মেয়াদ চলছে। যেখানে এক মেয়াদেই অ্যান্টি-ইনকামবেন্সির ধাক্কায় সরকার অজনপ্রিয় হয়ে যায়, সেখানে চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা কীভাবে সম্ভব? এটা সম্ভব হয়েছে, মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায়। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকায় আওয়ামী লীগ বারবার ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং সেই সুযোগ ষোলআনা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করছে। তবে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যে কমেছে, সেটা প্রমাণিত হয়েছে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেও। কিছু আসনে আওয়ামী লীগ নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তাতেই ৬২ আসনে জিতে যান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভরাডুবি ঘটেছে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা, এমপি এমনকি মন্ত্রীদেরও। ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয় আওয়ামী লীগের জন্য একটা বড় সতর্কবার্তা। সে আলোচনায় পরে আসছি।

শুরুতেই যেমনটি বলেছি, ক্ষমতায় থাকলে যে কোনো দল অজনপ্রিয় হয়ে যায়, এমনকি ভালো কাজ করলেও। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে আওয়ামী লীগই। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে। ২০০৮-এর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশে আকাশ-পাতাল ফারাক। ১০ বছর পর কেউ বাংলাদেশে এলে তিনি নিজের দেশকেই চিনতে পারবেন না। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতায় অনেক নতুন যুগে পা রেখেছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কর্ণফুলী টানেল, সাবমেরিন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র—একের পর এক বিস্ময় উপহার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার মর্যাদা পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে, সাধারণ মানুষ যা চেয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছে।

এতকিছুর পরও মানুষ আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করছে কেন? আসলে উন্নয়ন মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে। একসময় যারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকত, তারাও এখন মাংস খাওয়ার স্বাধীনতা চায়। কোয়ানটিটি বিবেচনায় উন্নয়ন অনেক হয়েছে, এখন ভাবতে হবে কোয়ালিটি নিয়ে। উন্নয়ন হতে হবে টেকসই এবং সর্বজনীন। গত ১৫ বছরে উন্নয়ন যেমন অনেক হয়েছে, বেড়েছে বৈষম্যও। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। সব মেগা প্রকল্পের সুফল সব মানুষ পায়নি। উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতিরও ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ব্যাংক খাতে লুটপাট, শেয়ারবাজারে কারসাজি, অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে বারবার। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হয়েছে; দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার রোধ করতে পারলে তা আরও কত বেশি হতে পারত—সেটাই এখন আফসোসের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

টানা চতুর্থ মেয়াদে এখন তাই সরকারকে টেকসই ও গুণগত মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। যে অর্থনীতি সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল, সেই অর্থনীতিই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। কভিডের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই একের পর এক যুদ্ধ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই টালমাটাল করে দিয়েছে। যার ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে এসেছে ২০ বিলিয়নের নিচে। ডলারের দামে পাগলা ঘোড়া দাবড়ানি দিয়েছে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারেও। দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে এক নম্বর অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। সরকার গঠন করার পরও দ্রব্যমূল্য নিয়েই তাদের সব চেষ্টা। রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের মূল্য এখন সরকারের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে। চেষ্টা আছে। কিন্তু সেই চেষ্টায় ফল আসাটা নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই সরকারের ভান্ডারে। তাই পিক মৌসুমে টান পড়ে উৎপাদনে। সামনে গরমের মৌসুম আসছে। বাংলাদেশ যে আবার লোডশেডিংয়ের কালে ফিরে যাবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। তাই বিদ্যুৎ খাতে অপচয় বন্ধ করে, বিকল্প জ্বালানির উৎস অনুসন্ধান করে সমস্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

তবে আওয়ামী লীগের মূল সমালোচনা রাজনীতির মাঠে। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগের সময়েই গণতন্ত্রহীনতার সমালোচনা সবচেয়ে প্রকট। আগেই যেমনটি বলেছি, বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকায় আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে রাজনীতি করছে। সংসদে কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই। রাজপথেও বিরোধী দলকে দমন করা হয় নিষ্ঠুর কায়দায়। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে এখন বিরোধী দল বা মত নেই প্রায়। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, সংসদের জন্য কার্যকর ও শক্তিশালী বিরোধী দল অপরিহার্য। সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় বিরোধী দলের মাধ্যমে। সব একদলীয় হয়ে গেলে ভুল করার সুযোগ তৈরি হয়। কেউ ধরিয়ে না দিলে ভুলটা যে ভুল সেটাও বুঝতে পারে না সরকার। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বহু দল থাকবে, বহু মত থাকবে; পক্ষ থাকবে, প্রতিপক্ষ থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নির্বাচন একতরফা হয়ে যাওয়ায় মানুষের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। ভোট দেওয়ার আগ্রহ কমে গেছে মানুষের। মানুষের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা ও ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কথা বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। বিচারবহির্ভূত সব ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

এত এত ভালো কাজ করেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমছে কেন? এর দায় আওয়ামী লীগেরই। প্রথম কথা হলো, শেখ হাসিনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করার মতো দূরদর্শী নেতা আওয়ামী লীগে নেই। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নানা অপকর্ম সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান করে দেয়। কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের অনেক অর্জন বিসর্জনে যায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অপকর্মে। নির্বাচনে জিততে আর ভোটারদের দরকার নেই, শেখ হাসিনা জিতিয়ে দেবেন; আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের মধ্যে এমন ধারণা প্রবল হয়েছে। তাই দিনের পর দিন তারা জনগণের কাছে যায়নি; বরং স্থানীয় এমপি বা আওয়ামী লীগ নেতাদের মাস্তানি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়েছে জনগণ। তাই এবার সুযোগ পেয়েই ৬২ জন স্বতন্ত্রকে জিতিয়ে দিয়েছে। যারা স্বতন্ত্র হিসেবে জিতেছে তারাও প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ; তবুও জনগণ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।

৭ জানুয়ারির নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগকে শিক্ষা নিতে হবে। জনগণের কাছে যেতে হবে। সরকারকে তাদের আগের তিন মেয়াদের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে, যাতে সামনে আরও ভালোভাবে দেশ চালানো যায়। টানা চার মেয়াদে জনগণ কিন্তু আর কোনো অজুহাত শুনবে না, সেটা বিদ্যুৎ খাতে হোক, বাজারদরে হোক। তার চেয়ে বড় কথা হলো, শুধু উন্নয়ন দিয়ে জনগণের হৃদয় জয় করা যাবে না। সমৃদ্ধির সঙ্গে চাই মতপ্রকাশের সুযোগ, ভোট দেওয়ার অধিকার, রাজনীতি করার অধিকার, চাই মানবাধিকার, চাই অসাম্প্রদায়িক ও পরমতসহিষ্ণু সমাজ।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাইপলাইনে গ্যাস, ১০ বছরেও আবেদন করেনি কেউ!

নারায়ণগঞ্জে নারী কাউন্সিলর লাঞ্ছিত, অতঃপর...

রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সদস্য সংগ্রহ করছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে বিএসপিএ স্পোর্টস কার্নিভাল

জামায়াতকে একমঞ্চে চায় ১২ দলীয় জোট

সৈয়দপুরে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ

মেক্সিকোতে শক্তিশালী ভূমিকম্প, ধ্বসে পড়েছে রাস্তাঘাট

‘সরকার দুর্নীতি দমন না করে বিএনপি দমনে ব্যস্ত’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে প্রণয় ভার্মার সাক্ষাৎ

ইউএস ট্রেড শো ২০২৪ / সেরা প্যাভিলিয়নের পুরস্কার জিতে শেষটা রাঙিয়ে তুলল রিমার্ক-হারল্যান

১০

সোমবার রাতে কুতুবদিয়ায় পৌঁছবে এমভি আব্দুল্লাহ

১১

জিপিএ-৫ পেল মেয়ে, দুশ্চিন্তায় রিকশাচালক পিতা

১২

মুখস্থ শিক্ষার ওপর নির্ভরতা কমাতে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী

১৩

রাশিয়ায় ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, নিহত ৭

১৪

বহুমুখী শিক্ষায় সীমাখালী ইসলামিয়া আইডিয়ালের ঈর্ষণীয় সাফল্য

১৫

অংকে ফেল করায় গলায় ফাঁস নিল কিশোরী

১৬

ইসরায়েলে পুলিশ-জনগণ সংঘর্ষ, ভয়ংকর বিপদে নেতানিয়াহু

১৭

পা দিয়ে লিখেই এসএসসি পাস করল সিয়াম

১৮

দোয়া কুনুত বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ

১৯

গ্রিন রোড থেকে রিকশার গ্যারেজ উচ্ছেদ, যান চলাচলে ফিরেছে স্বাচ্ছন্দ্য

২০
X