মানুষের মধ্য আছে নানা স্তর। একেক স্তরের মানুষের সঙ্গে একেক ধরনের ব্যবহার মানানসই। আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন মানবসমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের বৈচিত্র্য রক্ষায় একজন আদর্শ পুরুষ। ছিলেন পরিমার্জিত ব্যবহারের অধিকারী। কখনো কাউকে কটু কথার মাধ্যমে আঘাত করতেন না। সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসা করতেন। দরিদ্র-অসহায় মানুষের সঙ্গেও নিঃসংকোচে ওঠা-বসা করতেন। কাউকে নীচু মনে করতেন না। প্রতিটি মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতেন। সেভাবেই তাকে মূল্যায়ন করতেন। মানুষের প্রতি নম্র আচরণের জন্য সাহাবাদেরও উপদেশ দিতেন। অযথা রাগ ও ক্রুদ্ধ হওয়া থেকে বারণ করতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষমা করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে বিনীত হলে তিনি তার মর্যাদা সমুন্নত করে দেন।’ (মুসলিম : ৬৪৮৬)। সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে সাধারণত তার ব্যবহার কেমন ছিল—নিম্নে এমন কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো।
বড়দের সঙ্গে ব্যবহার: ইসলামের বিধান ও সামাজিক রীতি হলো—ছোট-বড়কে সম্মান করবে, বড় ছোটদের প্রতি স্নেহশীল হবে। রাসুল (সা.) তাই করতেন। ছোটদের তিনি স্নেহ করতেন। বড়দের সম্মান করতেন। তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না, সৎকাজের নির্দেশ দেয় না এবং অসৎ কাজে বাধা দেয় না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি : ১৯২১)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হছে, ‘কোনো মানুষ আল্লাহতায়ালাকে সম্মান করার একটি প্রমাণ হচ্ছে বৃদ্ধ মুসলিমদের প্রতি তার সম্মান প্রকাশ করা।’ (আবু দাউদ : ৪৮৪৩)।
ছোটদের সঙ্গে ব্যবহার: শিশুরা হলো মানববাগানের ফুল। তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ বা রাগারাগি করার অর্থ বাগানের ফুলকে ধ্বংস করা। তাই রাসুল (সা.) কখনো শিশুদের সঙ্গে মন্দ আচরণ করতেন না। রাগারাগি করতেন না। পরম আদরে তিনি তাদের কাছে ডাকতেন। কোলে নিতেন। তাদের সঙ্গে সুন্দর ভাষায় কথা বলতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) একদা হাসান বিন আলিকে চুম্বন করেন। সে সময় তার নিকট আকরা বিন হাবিস তামিমি (রা.) উপবিষ্ট ছিলেন। আকরা বিন হাবিস (রা.) বললেন, ‘আমার দশজন পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুম্বন করিনি। রাসুল (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন—যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।’ (বোখারি : ৫৯৯৭)
সহচরদের সঙ্গে ব্যবহার: রাসুল (সা.) তার প্রিয় সাহাবিদের সঙ্গে সর্বদা উত্তম আচরণ করতেন। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমি ইসলাম কবুলের পর থেকে রাসুল (সা.) আমাকে (তার নিকট প্রবেশে) বাধা দেননি এবং তিনি আমার দিকে হাসিমুখ ব্যতীত দৃষ্টিপাত করতেন না।’ হজরত আবু জর ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, ‘রাসুল (সা.) এসে সাধারণত সাহাবিদের মধ্যেই বসতেন। ফলে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি আসলে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত বলতে পারতেন না যে, কোন ব্যক্তিটি নবী (সা.)!’ (আবু দাউদ : ৪৬৯৮; মুসলিম : ৬২৫৭)। তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে সাহাবিদের সঙ্গে নানা কাজেও শরিক হতেন। হজরত বারা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবীজি (সা.) খন্দক যুদ্ধের দিন মাটি বহন করেছিলেন। এমনকি মাটি তার পেট ঢেকে ফেলেছিল।’ (বোখারি : ৪১০৪)
সেবকদের সঙ্গে ব্যবহার: দুনিয়ার জীবনে কেউ স্বনির্ভর নয়। নানাভাবে সবাই একে অন্যের মুখাপেক্ষী। সুষ্ঠু-সুন্দর জীবন পরিচালনায় প্রয়োজন হয় অন্যের সেবা গ্রহণের। প্রয়োজন হয় সেবকের। সেবকদের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর আচরণ ছিল মধুর। তাদের সঙ্গে কখনো তিনি মন্দ আচরণ করতেন না। কাজেকর্মে কোনো ভুল হলে উত্তম পন্থায় শুধরে দিতেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দশ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছি। আল্লাহর কসম! তিনি কোনো দিন আমাকে বকা দেননি। কোনো দিন উফ বলেননি। এমনকি কখনো বলেননি এ কাজটি কেন করেছ? ও কাজটি কেন করোনি?’ (বোখারি : ৬৪৩০)
প্রতিবেশীর সঙ্গে ব্যবহার: সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর সঙ্গে রাসুল (সা.) ভালো আচরণ করতেন। কখনো কোনো আচরণে তাদের কষ্ট দিতেন না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ইমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে।’ (মুসলিম : ১৮৫)। প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণের পাশাপাশি সদা-সর্বদা তাদের খোঁজখবর রাখতেন। এমনকি এ ব্যাপারে তিনি সাহাবাদেরও আদেশ করেন। যেমন রাসুল (সা.) হজরত আবু জর (রা.)-কে বলেন, ‘হে আবু জর, তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো।’ (মুসলিম : ২৬২৫)
অমুসলিমদের সঙ্গে ব্যবহার: হজরত জাবের (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদিন আমাদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা দেখে রাসুল (সা.) দাঁড়িয়ে গেলেন। তার দেখাদেখি আমরাও দাঁড়ালাম। আমরা তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! এ তো এক ইহুদির লাশ! তখন তিনি বললেন, যখন কোনো লাশ নিতে দেখবে, তখন দাঁড়াবে।’ (বোখারি : ১৩১১)। অমুসলিম যদি কারও আত্মীয় হয় তার সঙ্গে মধ্যমপন্থায় আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখার ব্যাপারে রাসুল (সা.) আদেশ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, ‘যে আল্লাহ ও পরকালে ইমান এনেছে সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’ (বোখারি : ৬১৩৮)। এ ছাড়া শ্রেণিভেদে রাসুল (সা.)-এর উত্তম আচরণের আরও অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। তাই আমাদের উচিত সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা।
লেখক: আলেম ও প্রাবন্ধিক