১৩৮৯ সালের ১৫ জুন কসোভোর মাটিতে তৎকালীন কসোভোর শাসক ও সার্বিয়ার রাজপুত্র লাজার এবং অটোমান তথা তুরস্ক ও মুসলিম জাহানের সম্রাট মুরাদের মধ্যে এক যুদ্ধ হয়, যা ইতিহাসের পাতায় বলকান যুদ্ধ নামে পরিচিতি পেয়েছে। যুদ্ধে উভয়পক্ষের সেনাপতি তথা দুই সম্রাট প্রাণ হারালেও শেষ বিচারে বিজয় হয় অটোমান বাহিনীর। ১৩৮৯ সালে কসোভোর এমন পতনের মধ্য দিয়ে এ বলকান অঞ্চলে অটোমান তথা মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা চলে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। এ সময়ে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হয়, যার ফলে কসোভোতে আজ প্রায় ৯৬ শতাংশ মানুষই মুসলমান। তবে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন নিয়মকানুন ও আচার-আচরণ মেনে চলার ক্ষেত্রে এসব মুসলমানের অনেকের মধ্যেই শিথিলতা লক্ষ করা যায়। বিশেষত নামাজ পড়ার বিষয়ে অনেকেরই আগ্রহ কম এবং ধর্মীয় জ্ঞানের দিক থেকেও তারা পিছিয়ে আছে। তবে পবিত্র রমজান মাস শুরু হলে রোজা রাখার বিষয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন কসোভোতে বসবাস করা অধিকাংশ মুসলমান। দুই ঈদের সময়ও তাদের পরিবার-পরিজনসহ মসজিদ ও ঈদগাহে নামাজ আদায়ের জন্য সমবেত হতে দেখা যায়।
বলকান যুদ্ধে অটোমান সম্রাট মুরাদের মৃত্যুর পর তারই পুত্র প্রথম বায়েজিদ নতুন সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একই বছর (১৩৮৯ সাল) কসোভোর বিখ্যাত শহর (বর্তমান রাজধানী) প্রিস্টিনার কেন্দ্রস্থলে মুসলমানদের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর বেশ কয়েক বছর এমনকি পঞ্চদশ শতকে অটোমান সম্রাট দ্বিতীয় মুরাদের আমলেও মসজিদের নির্মাণকাজ চলতে থাকে। প্রায় ৬০০ বছরের পথ চলায় এ মসজিদটি পরিচিতি পেয়েছে কুরসি মস্ক, বাজার মস্ক, টাস মস্ক প্রভৃতি নামে। স্থানীয়ভাবে টাস শব্দটির অর্থ পাথর। তাই মসজিদটি টাস মস্ক বা পাথর মসজিদ নামে বেশি পরিচিত। এ মসজিদের সার্বিক ভৌত অবকাঠামো বিশেষত মসজিদের ভিত, দেয়াল, গম্বুজ ও মিনারে ব্যাপকভাবে স্থানীয় ভারী পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংস্কার হলেও ৬০০ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে পাথরে নির্মিত এ মসজিদ বলকান অঞ্চলের অটোমানদের তথা মুসলমানদের আধিপত্যের প্রতীকরূপে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষত পাথরে নির্মিত সুউচ্চ মিনারটির ৬০০ বছরের অক্ষত অবয়ব ধরে রেখে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
কসোভোতে মানবসভ্যতা ও ইতিহাস বিবর্তনের অন্যতম মাইলফলক এ পাথর মসজিদ। চারকোণ আকৃতির মসজিদে মূল নামাজের ঘর, একটি উঁচু বারান্দা ও একটি মিনার রয়েছে। নামাজের ঘরটির ওপরে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় গম্বুজ। তিন সারিতে নির্মিত জানালা দিয়ে মসজিদে প্রচুর আলো-বাতাস প্রবেশ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মসজিদে ডানে অবস্থিত মিনারের ওপরে ও গম্বুজের ওপর থাকা উজ্জ্বল সরু অগ্রভাগ অনেক দূর থেকে সবার নজর কাড়ে। মসজিদের পাশে অনেক আগেই পাথর দিয়ে একটি ঝর্ণা নির্মিত হয়েছিল। যুগের পর যুগ স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকরা এ ঝর্ণার পানি পান করত। ২০১৮ সালে তুরস্ক সরকার কসোভোর সঙ্গে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করে সেই ঝর্ণা সংস্কার করে এবং এর পানিতে অজু করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
মসজিদের ইমাম দাঁড়ানোর পাশেই উঁচু স্থান ও মিহরাব আছে যেখান থেকে ধর্মীয় আলোচনা করা হয়। অন্য পাশে রয়েছে বসার স্থান, সেখানে বসেও ইমাম সাহেব আগত মুসল্লিদের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ে কথা বলে থাকেন। মসজিদের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য আঁকা হয়েছে বেশ কিছু জ্যামিতিক গ্রাফিকস। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু আয়াত রয়েছে মসজিদের দেয়াল ও গম্বুজের নিচে। নীল, বেগুনি, সবুজ ও উজ্জ্বল বাদামি রঙের ব্যাপক ব্যবহার মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন নকশার মধ্যে রয়েছে একটি নামফলক, যেখানে মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত দাতাদের নাম ও নির্মাণকাল উদ্ধৃত রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন রঙের বৈদ্যুতিক আলো রাতে মসজিদের এক স্বপ্নীল রূপ ফুটিয়ে তোলে। আর দিনের বেলা মসজিদসংলগ্ন বাগানটি দর্শনার্থীদের মনে প্রশান্তি জোগায়।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর, গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট