প্রভাষ আমিন
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ০২:৩২ এএম
আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৪, ০৮:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দেশ তো স্মার্ট হবে, ঢাকা কবে?

দেশ তো স্মার্ট হবে, ঢাকা কবে?

বিদেশি কেউ বাংলাদেশে কাজে বা বেড়াতে এলে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কণ্ঠে মুগ্ধতাই ঝরে। আতিথেয়তা, পরিবেশ, খাবার—সব মিলিয়ে দ্রুত তারা বাংলাদেশকে আপন করে নেন। একটা ব্যাপারে তাদের প্রবল বিরক্তি। সেটা হলো যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহনীয় যানজটে বসে থাকার বিষয়টি তাদের বিরক্ত করে। শুধু বিদেশি নয়, দেশের মানুষও যানজটে বিরক্ত হয়। তবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যানজটে আটকে থাকতে থাকতে বিরক্তিটা তাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তবে গা-সওয়া যানজটও মাঝেমধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে কত কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, তাতে কত টাকার ক্ষতি; তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সেটা পরোক্ষ ক্ষতি। কিন্তু যানজটের কারণে যখন অফিসে দেরি হয়ে যায়, পরীক্ষা মিস হয়ে যায়, গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়ে যায়, রাস্তায় ইফতার সারতে হয়; তখন আর সহ্য হয় না। কিন্তু সহ্য না হলেও আমাদের কিছু করার নেই। রাস্তায় গালাগাল করা, বেশি রাগ হলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস ঝারি। আর কিছু করার নেই আমাদের।

যানজট আমাদের অনেক পুরোনো সমস্যা। প্রথম যখন ঢাকায় ফ্লাইওভার হলো, আমরা ভাবলাম এই বুঝি যানজট খতম। তারপর একের পর এক ফ্লাইওভার হলো, কিন্তু যানজট আর কমলো না। এরপর এলো মেট্রোরেল, এলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আমরা ভেবেছি, এবার বুঝি যানজট পালাল। কিন্তু হা হতাস্মি। অনেকে বলতে পারেন, তাহলে হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে বানিয়ে লাভ কী হলো। লাভ হলো এই—এগুলো না থাকলে ঢাকা এখন অচল থাকত। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়েতে ক্রমবর্ধমান যানজটের সমন্বয় হয়েছে। একটি শহরে অন্তত ২৫ ভাগ রাস্তা থাকার কথা। ঢাকায় আছে মাত্র আট ভাগ। প্রয়োজনের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ সড়ক নিয়ে একটি শহর এখনো চলছে, এটাই তো বিস্ময়ের। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে নতুন করে রাস্তা বাড়ানো কঠিনই শুধু নয়, প্রায় অসম্ভব। তাই তো আকাশপথ, আকাশ রেল, পাতাল রেল—নানা বিকল্প ভাবনা।

তবে আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, যদি আইন না মানি, যদি আইনের কঠোর প্রয়োগ না হয়; তাহলে যানজট নিরসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ছেলেবেলায় আমার ছেলে প্রসূন আমিনও যানজট খুব অপছন্দ করত। সে খুব বোকার মতো প্রশ্ন করত, বাবা সামনের গাড়িটা চলছে না কেন? আমি বলতাম, সামনের গাড়ির সামনেও গাড়ি আছে। এরপর সে বলত, তাহলে সামনের গাড়িটা চলছে না কেন? এভাবে বলতে বলতে সে বলত, সবার সামনের গাড়িটা চলছে না কেন? বোকার মতো হলেও এটা আসলে যৌক্তিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর জানলেই সমস্যার অনেকটা জানা হয়ে যায়। আমি অনেক যানজটের কারণ খুঁজতে সামনে গিয়ে দেখেছি, আসলে তেমন কোনো কারণ নেই। হয়তো দুই বাস প্রতিযোগিতা করে রাস্তা আটকে রেখেছে বা দুই রিকশায় মারামারি লেগেছে বা পুলিশ মাঝ রাস্তায় গাড়ি আটকে টাকা খাচ্ছে।

একে তো রাস্তা কম, তার ওপর মানুষ বেশি, যানবাহনও বেশি। সংখ্যাটা জানি না, বিআরটিএতে খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে, প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নতুন নতুন গাড়ি নামছে। কিন্তু একটা গাড়িও কমছে না। কারণ আমাদের দেশে দুর্ঘটনায় একেবারে বাতিল না হয়ে গেলে রাস্তা থেকে কোনো গাড়ি সরছে না। সিএনজি বা এলপিজিতে গাড়ি চালানোর সুবিধা আসার পর গাড়ি এখন মধ্যবিত্তের নাগালেও চলে এসেছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে গাড়ির চাপ। তার মানে যত দিন যাবে, যানজট তত বাড়বে। মেট্রোরেলের একটা রুটেই যানজট অনেকটা সমন্বয় হয়েছে। তবে ৬ রুটে মেট্রোরেল চালু হলে হয়তো পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হতে পারে।

তবে আমরা যদি স্মার্ট না হই, আইন না মানি, তাহলে কিছুতেই কিছু কাজ হবে না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আরামটা নিচে নামলেই শেষ। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ফার্মগেটে নামলেই যানজটে আটকে যেতে হয়। কুড়িল পয়েন্টে রিকশার কারণে নামাই যায় না। এফডিসি র‌্যাম্প চালু হওয়ার পর হাতিরঝিলের আরামও শেষ। সেদিন একজন পরিবহন মালিক বলছিলেন, ঢাকায় ১৭ কিলোমটির দূরত্ব পাড়ি দিতে একটি গাড়ির তিন ঘণ্টা লাগে। আর ঢাকা-কুমিল্লার ১০০ কিলোমিটার পথ যেতে লাগে দুই ঘণ্টা। ঢাকায় তারা কীভাবে গাড়ি চালাবেন?

রমজানে যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ নানা পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু কাজে আসেনি কোনোটাই। সাড়ে ৩টায় অফিস ছুটির পর থেকে ইফতার পর্যন্ত রাস্তায় অসহনীয় যানজট থাকে। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে রাস্তায় ইফতার করতে হয়। ইফতারের পর রাস্তা বেশ ফাঁকা থাকে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকে মানুষ যখন সন্ধ্যার পর কেনাকাটা করতে বেরুবে, তখন ইফতারের পরের আরামটাও আর থাকবে না।

কম রাস্তা, বেশি গাড়ি; যানজটের এই সহজ সমীকরণ তো আছেই; তবে আমার ধারণা, তার চেয়ে বেশি যানজট হয় রাস্তার অব্যবস্থাপনার কারণে। একই শহরে সেনানিবাসের ভেতরে যিনি লেন মেনে, স্পিড লিমিট মেনে গাড়ি চালান; জাহাঙ্গীর গেট পেরুলেই তিনি বনে যান রাস্তার রাজা। একটু সিগন্যালে পড়লেই আমরা উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে দিই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বড় বাসগুলো দিব্যি উল্টোপথে চলে এসে যানজটকে করে দীর্ঘস্থায়ী। ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেই আমরা মন্ত্রীকে ফোন করি, এমপিকে ফোন করি, পুলিশের বড় কর্তাকে ফোন করি। ট্রাফিক পুলিশ অসহায় বনে যায়। দামি গাড়ি দেখলে পুলিশ ভয়েও থামায় না। আর গাড়ির সামনে যখন লেখা থাকে ‘পুলিশ, আইনজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার’ তখন পুলিশ আরও অসহায় বনে যায়। যানজট পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে ট্রাফিক পুলিশকে অন্ধ হতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

ইফতারটা যেমন তেমন, সামনের ঈদে যারা বাড়ি যেতে চান; তারা এখনই ভোগান্তির জন্য তৈরি হয়ে যান। এবার ঈদের ছুটি লম্বা হবে। তাই অনেক বেশি মানুষ ঢাকার বাইরে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একটি পত্রিকা লিখেছে, ঈদের আগের চার দিনে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাড়ি যাবে। তার মানে দিনে গড়ে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বে। কিন্তু বিদ্যমান পরিবহন ব্যবস্থায় ২২ লাখ লোক পরিবহন সম্ভব। বাকিরা কি বাড়ি যাবেন না? অবশ্যই যাবেন। ছাদে চড়ে, ঝুলে, ট্রাকে করে বাড়ি যাবেনই। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে এক বৈঠকে অন্তত ১৫৫টি স্থানে যানজট হতে পারে। সরকার নানা চেষ্টা করছে। হয়তো ১৫৫ পয়েন্টে বাড়তি নজর থাকবে। তাতে ভোগান্তি হয়তো কমানো যাবে, কিন্তু অবসান হবে না।

হঠাৎ করেই আলোচনায় ‘লক্কড়-ঝক্কড়’ বাস। গত সপ্তাহে একাধিক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের লক্কড়-ঝক্বড় বাস নিয়ে কথা বলেছেন। ২০ মার্চ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি র‌্যাম্প উদ্বোধনের সময় সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, ১২ বছর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার পরও লক্কড়-ঝক্কড় বাস সরাতে পারেননি কেন? ক্ষুব্ধ ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মন্ত্রী কি নিজে গিয়ে বাসে রং করে আসবে। তিনি দাবি করেন, চাইলেও লক্কড়-ঝক্কড় বাস সরানো সম্ভব নয়। কারণ তাহলে জনগণের কষ্ট হবে। পরদিন বিআরটিএতে ঈদকে সামনে রেখে এক সমন্বয় সভায় মন্ত্রী স্বীকার করেন, লক্কড়-ঝক্কড় বাস দেশের উন্নয়ন-অর্জনের লজ্জা। কিন্তু শুধু স্বীকার করলেই হবে না। এই লজ্জা দূর করতে হবে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে সেতু বানাব, এক্সপ্রেসওয়ে বানাব, মেট্রোরেল বানাব আর ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে বদলাতে পারব না—এটা হতে পারে না। চাইলেই ঢাকায় একটি আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। ১২ বছর দায়িত্বে থাকা একজন মন্ত্রীর কাছে কোনো অজুহাত শুনতে চাই না আমরা। দেশ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকাকেই যদি আমরা স্মার্ট বানাতে না পারি, তাহলে দেশ কীভাবে স্মার্ট হবে?

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কচুরিপানা পরিষ্কার করতে খালে নামলেন প্রাণ গোপাল

ফের কমলো সোনার দাম

ওবায়দুল কাদের ঘুমের মধ্যেও বিএনপি বিএনপি করতে থাকেন : সালাম

উপজেলা নির্বাচন / এমপিদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা : রাশেদা সুলতানা

হিট অফিসার শুধু পরামর্শ দেন, বাস্তবায়ন করতে হবে আমাদের: মেয়র আতিক

কারাবন্দিদের সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিতে ‘জরুরি আলাপ’

রাজধানীতে হঠাৎ বাসে আগুন

জুয়ার আসর থেকে ইউপি সদস্যসহ আটক ৮

তাপমাত্রা নিয়ে আরও বড় দুঃসংবাদ

ড. মাহবুব উল্লাহর ‘আমার জীবন আমার সংগ্রাম’ বইয়ের পাঠ উন্মোচন 

১০

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছের এ ইউনিটের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

১১

সহকারী ব্যবস্থাপক পদে ওয়ালটনে চাকরি, থাকছে নানা সুবিধা

১২

বিএনপির আরও ৩ নেতা বহিষ্কার

১৩

নোমান গ্রুপে চাকরি, বেতন ৬০ হাজার

১৪

জানা গেল নারী বিশ্বকাপ শুরুর দিনক্ষণ 

১৫

ফল কেলেঙ্কারি / শাস্তি পাওয়া সেই এসএসএ’র হাতেই রেজাল্ট তৈরির কাজ!

১৬

৪৩ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে কালবৈশাখী

১৭

রাজধানীতে বাসার ছাদ থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু

১৮

লাইসেন্স ও ফিটনেস নেই বেশিরভাগ গাড়ির

১৯

রাজশাহীতে খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু

২০
*/ ?>
X