মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৮ এএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:২৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে অর্থনৈতিক ইবাদতের গুরুত্ব

ইসলামে অর্থনৈতিক ইবাদতের গুরুত্ব

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। জীবনের পরতে পরতে প্রতিটি প্রসঙ্গে আলো ফেলেছে ইসলামের ঐশী বিধান। ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যেমন ফরজ ইবাদত, তেমনি হালাল উপায়ে সম্পদ উপার্জন করাও আবশ্যক। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘হালাল উপার্জন করাও অন্যান্য ফরজের পর একটি ফরজ কাজ।’ (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান : ৮৭৪১)

হালাল গ্রহণ করা আল্লাহতায়ালার হুকুম। ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা রয়েছে, তা থেকে আহার করো। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। ইবাদত কবুলের জন্য হালাল খাদ্য গ্রহণ অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ ব্যবহার করে ইবাদত করলে তা কবুল হবে না। হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ১০ দিরহাম দিয়ে কোনো বস্ত্র ক্রয় করে এবং সেই ১০ দিরহামের মধ্যে একটি দিরহামও হারাম হয়, যতক্ষণ সেই বস্ত্র তার পরিধানে থাকবে ততক্ষণ তার নামাজ কবুল হবে না।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৭৩২)

অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে সত্তার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ তার কসম, নিশ্চয়ই কোনো বান্দার পেটে যদি এক লোকমাও হারাম খাবার প্রবেশ করে, ৪০ দিন পর্যন্ত তার ইবাদত কবুল হবে না। আর যে রক্ত-মাংস হারাম সম্পদ বা সুদের টাকায় বৃদ্ধি হয়েছে, তার জন্য জাহান্নামই উত্তম।’ (আলমুজামুল আওসাত : ৬৪৯৫; আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ২৬৬০)

ইসলামে হারাম ও অবৈধ উপার্জনকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। হারাম সম্পদের তুচ্ছতায় তা মাটির সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার প্রাণ যার হাতে তার কসম, তোমাদের কেউ মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম হলো সে তার রশি নিয়ে পাহাড়ে যাবে এবং কাঠ সংগ্রহ করবে। অতঃপর তা পিঠে বহন করে এনে বিক্রি করবে এবং আহারের ব্যবস্থা করবে। আর তোমাদের কেউ হারাম খাওয়ার চেয়ে উত্তম হলো নিজের মুখের মধ্যে মাটি ভরা।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৭৪৯০)। অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জন করলে কেয়ামতের কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের ময়দানে কোনো বান্দা তার এক পাও নড়াতে পারবে না; যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে—১. সে তার জীবন কোন পথে শেষ করেছে। ২. যতটুকু ইলম শিখেছে তার ওপর কতটুকু আমল করেছে। ৩. সম্পদ কোন পথে আয় করেছে। ৪. এবং কোন পথে ব্যয় করেছে। ৫. নিজের যৌবনকে কোন পথে শেষ করেছে।’ (তিরমিজি : ২৪১৭)।

সুতরাং আমরা যখন সম্পদের আয়-ব্যয়ের হিসাব করি তখন কোন পথে আয় করছি এবং কোন পথে ব্যয় করছি সেটারও হিসাব নিতে হবে।

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে জাকাত ও ফিতরার প্রচলন করা হয়েছে। যাতে ধন-সম্পদ শুধু ধনীদের মধ্যে ঘুরপাক না খায়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমাদের (ধনীদের) সম্পদে রয়েছে অভাবী ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ (সুরা জারিআত, আয়াত : ১৯)। আমরা সহিহ হাদিস থেকে জানতে পারি, পবিত্র রমজানে এক টাকা দানে সত্তরের অধিক টাকা দানের সওয়াব পাওয়া যায়। তাই জাকাত, সদকা (দান) ও ফিতরা প্রদানের উত্তম সময় নিঃসন্দেহে এই রমজান মাস। ইসলামে জাকাত কে দেবে, কে পাবে, কোন কোন খাতে ব্যয় হবে ইত্যাদি সব সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। জাকাত দানকারীর সম্পদের নিসাব (নির্ধারিত পরিমাণ) হলো ৭ তোলা সোনা অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা ব্যবসা পণ্য যদি বছরান্তে অবশিষ্ট থাকে, তবে তার সম্পদের শতকরা আড়াই শতাংশ হিসাবে আল্লাহর নির্ধারিত খাতে গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বণ্টন করতে হয়।

পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবার ৬০ আয়াতে বলা হয়েছে, জাকাত আট শ্রেণির মানুষের মাঝে বণ্টন করতে হবে—১. ফকির, ২. মিসকিন, ৩. জাকাত আদায়কর্মী, ৪. নও মুসলিম ও অনুরাগী, ৫. দাস-দাসী মুক্তিপণ, ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, ৭. ইসলামের পথে সংগ্রামরত ব্যক্তি, ৮. বিপদগ্রস্ত মুসাফির। এই আট শ্রেণির মধ্যে জাকাতের অর্থ বণ্টন করে দেওয়া যাবে। তবে বর্তমানে প্রচলিত শাড়ি-লুঙ্গি প্রদানের যে সিস্টেম চালু হয়েছে, তা ইসলামী অর্থনীতিতে; বিশেষত জাকাতের কর্মকৌশলবিরোধী। কেননা জাকাতের উদ্দেশ্য হলো স্বাবলম্বী করা। অর্থাৎ এ বছর যে ব্যক্তিকে জাকাত দেওয়া হবে, সে যেন আগামীতে কারও কাছে হাত না পাতে। তার মানে, জাকাতের অর্থ দিয়ে অভাবী দরিদ্র ব্যক্তিকে আয়ের পথ বের করে দিতে হবে। প্রয়োজনে দশজনের জাকাতের অর্থ একত্র করে একজন অভাবীকে দিতে হবে। যেন সে ছোটখাটো ব্যবসা অথবা পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে।

ইসলামে জাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়ের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও রমজান মাসই জাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। ফলে এ সময় বিত্তবানরা দান-সদকা ও জাকাত-ফিতরা প্রদানে উৎসাহিত হন। জাকাত প্রদানের ফলে ধনী-গরিবের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে। তাই নবী কারিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘জাকাত ইসলামের সেতু।’ (মুসলিম)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বস্তুর একটি জাকাত রয়েছে আর মানুষের দেহের জাকাত হলো সাওম।’ (ইবনে মাজা)। আর জাকাত আদায়ে সম্পদ পবিত্র হয়। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের জাকাত প্রদান করে, তার সম্পদের দোষ দূর হয়।’ (মেশকাত)। জাকাত আদায় করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। ধনী লোকেরা যদি ঠিকমতো জাকাত আদায় করেন, তাহলে সমাজে কোনো অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, শিক্ষাহীন লোক থাকতে পারে না। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি জাকাত আদায় করে, তখন ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করে।’ (মেশকাত)

পবিত্র মাহে রমজানে প্রদেয় আরেকটি আমল হচ্ছে ফিতরা। ঈদের সালাতের আগেই ফিতরা আদায় করা নিয়ম। রাসুল (সা.) লোকজন ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (বোখারি, হাদিস : ১৫০৯)। অবশ্য কোনো কোনো সাহাবি থেকে ঈদের কয়েক দিন আগেও ফিতরা আদায়ের কথা প্রমাণিত আছে। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দুয়েক দিন আগেই ফিতরা আদায় করে দিতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৬)। সুতরাং ফিতরা রমজানের মধ্যে আদায় করলে অতিরিক্ত সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। এতে গরিব অসহায় মানুষরা ঈদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারেন সানন্দে। রোজা রাখতে গিয়ে যেসব ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে, তা থেকে মুক্ত হতে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পর ঈদের নামাজের আগে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। আমরা যদি ইসলামের অর্থনৈতিক ইবাদতগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পালন করি, তাহলে আমাদের পার্থিব ও পরকালীন জীবন হবে সুখময় ও বরকতময়। তেমনি সমাজ থেকেও দূরীভূত হবে অভাব, দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও সব ধরনের অর্থনৈতিক অস্থিরতা। আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইপিজেড ও বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে দক্ষিণ কোরীয় বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ

রাজনীতি ঠিক না থাকায় অর্থনীতি ভয়ংকর : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

গাজীপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ, পদসংখ্যা ৫৬

হিটস্ট্রোকে আ.লীগ নেতার মৃত্যু

দেশে অর্থনৈতিক সংকট ঘণীভূত হচ্ছে: খেলাফত মজলিস

বুটেক্সে সুপেয় পানির অভাব, নানা সমস্যা ওয়াশরুমগুলোতে

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশ, সেই আ.লীগ নেতা কারাগারে

গুচ্ছের এ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা / জবিতে মোট উপস্থিতি ৮৩ শতাংশ

জায়েদকে ফিরিয়ে আনছেন ডিপজল

হেলিকপ্টারে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

১০

মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন

১১

আবারও দাম বাড়ল পেঁয়াজের

১২

হাসপাতালে ডাক্তার না পাওয়া গেলে ব্যবস্থা : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

১৩

ভূমিকম্পে কাঁপল জাপান

১৪

ভারত সিরিজকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতির ভালো সুযোগ হিসেবে দেখছেন জ্যোতি 

১৫

সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পুড়ছে চুয়াডাঙ্গা

১৬

রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যানকে ডার্মাটোলজি জার্নালিস্ট ফোরামের শুভেচ্ছা

১৭

সেভ দ্য চিলড্রেনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, থাকছে না বয়সসীমা

১৮

সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙার আশঙ্কা যে ৬ জেলায় 

১৯

মেসি ফ্যানদের স্কোয়াডে রাখবেন না কোচ  

২০
*/ ?>
X