কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩১ এএম
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রেজোয়ান হকের নিবন্ধ

জিয়াউর রহমান ভারতের কাছে গ্যাস বেচতে চেয়েছিলেন?

জিয়াউর রহমান ভারতের কাছে গ্যাস বেচতে চেয়েছিলেন?

সাম্প্রতিককালের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ ইস্যুতে বিএনপি ভারতের ব্যাপারে তার বরাবরের অনুসরণ করা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো ওভার স্মার্ট টাইপের অবস্থানেই থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এটি বেশ সুবিধাজনক। আছি বা নেই—দুটিই বলা যায়।

ইউটিউবারদের রাজনীতিবিদ বা দলকে অনুসরণ করার কথা, কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। খালেদা জিয়া, তারেক রহমান বা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের চেয়েও বড় বিএনপির মতো কিছু ইউটিউবারের ‘আমেরিকা সব ব্যবস্থা করছে—সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র’—এ ধরনের অবাস্তব কথাবার্তায় বিএনপি নেতারা পর্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে আন্দোলনের চেয়ে আমেরিকামুখী হয়ে পড়েছিলেন বেশি। সেই ইউটিউবারদের পাল্লায় ফের পড়েছে দলটি।

তাদের কারও কারও ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’-এর ডাকে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সাড়া না দিলেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নেতা বলে পরিচিত রিজভী আহমেদ এরই মধ্যে প্রকাশ্যে তার ভারতীয় শাল বিসর্জন দিয়েছেন, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গত সোমবার নয়াপল্টনে দলের অফিসের সামনে এক সমাবেশে মঞ্চের পেছনের ব্যানারে ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বড় করে লেখা ছিল। কিন্তু নেতারা বলছেন, দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মানে সেই একই—আছি আবার নেই-ও।

অথচ ভারত বিরোধিতাই বিএনপির রাজনীতির সবচেয়ে বড় অস্ত্র, মূলত এর সূচনা হয়েছিল খালেদা জিয়া দলটির নেতৃত্বে আসার পর। আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৯১ সালের নির্বাচনী প্রচারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ নেতারা বলতেন, আওয়ামী লীগ ভারতের দালাল, তারা ক্ষমতায় এলে সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ তুলে দেবে, মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি করতে গেলে বিএনপি বলেছিল, এ চুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে এলে আগে থেকে নির্ধারিত সৌজন্য সাক্ষাতে যাননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারতীয়রা যাকে তাদের রাষ্ট্রের অপমান বলে এখনো মনে করে।

দলটির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান কিন্তু ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি দুবার ভারত সফর করেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম সফরের আগেই তিনি দুদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি করতে সমর্থ হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই বলেন, ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির আমেরিকান প্রস্তাব মানেননি বলে ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। সুসম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে জিয়াউর রহমান কিন্তু ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন ১৯৮০ সালে দ্বিতীয়বার দিল্লি সফরের পরপরই।

সে সময় বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবে পরে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, ‘গ্যাস বিক্রির সব কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছিল, শুধু দামটা ছাড়া। কী পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি হবে, কোথায় কারা পাইপলাইন বসাবে—সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দাম নিয়ে আলোচনা চলছিল। জিয়া চাইছিলেন বাজারদরে গ্যাস বেচতে, আমরা বলছিলাম কস্ট প্লাস ফর্মুলায় দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে দাম ঠিক হোক। তাকে হত্যার পর সব ভেস্তে যায়।’ (বিবিসি নিউজ বাংলা অনলাইন, ৩০ মে ২০২১)

১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির ভারত নীতি দাঁড়িয়েছে অনেকটা ‘মুখে মধু অন্তরে বিষ’-এর মতো। কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক দরকার—বিএনপি তা বুঝে বলেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তাদের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারত সফরে গিয়েছিল। সেই দলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর। সেই সফরে কবীর ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পেছনে না তাকিয়ে আমাদের সামনের দিকে তাকানো উচিত। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে খারাপ সম্পর্ক ছিল, তা ‘ভুল ও বোকামিপূর্ণ’ নীতির ফসল। তারেক রহমান চান, আমরা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলি।’

এ সফর সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ ও সেখানকার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য কী প্রয়োজন, সে সম্পর্কে বিএনপির চাওয়াগুলো তাদের জানানো হয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০১৮)

অর্থাৎ আমাদের দেশের ভালো নির্বাচনের জন্য বিএনপি কী চায়, তা নিয়ে তারা আলোচনা করেছে ভারতের সঙ্গে। ভালো নির্বাচন বলতে আমাদের দলগুলো বোঝে বিজয়ী হওয়া। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। কিন্তু যে দলই হেরেছে তারাই কারচুপির অভিযোগ করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের সফরে কিংবা এবারের নির্বাচনে ভারতের কাছে বিএনপির যা প্রত্যাশা ছিল, তা পূরণ না হওয়াই বিএনপির ক্ষোভের মূল কারণ।

পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকার কারণে বিএনপি এবার ধরেই নিয়েছিল সরকারের পতন অনিবার্য, সময়ের ব্যাপার মাত্র। যেসব ইউটিউবারের কথা শুরুতে বলেছি, তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একজন এমনও বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে কিছুই করতে হবে না, যা করার আমেরিকাই করে দেবে।’ বিএনপির ধারণা, আমেরিকাকে ভারত মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে। ‘বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া’র মতো ব্যাপার। সেই রাগ-ক্ষোভের আগুনেই নিজের ভারতীয় শাল পুড়িয়েছেন রিজভী আহমেদ, প্রকাশ্যে কিছু বলার সামর্থ্য না থাকলেও একই যন্ত্রণা থেকে অন্যদের মৌন সমর্থনও পাচ্ছেন রিজভী।

এই রাজনীতি বিএনপিকে কোনো সুবিধা দেবে কি না, তা সময়ই বলবে। এতে যদি তাদের ক্ষোভ কিছুটা কমে, সেটাও খারাপ নয়। তবে ইতিবাচক দিক হলো, দল এবং আন্দোলনের আসল দুর্বলতা বিএনপি বুঝতে পারছে। গত দুই থেকে তিন দিনে দুটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দল হিসেবে যতটা আন্দোলন করা সম্ভব, বিএনপি তার চেয়ে বেশিই করেছে, এখন দরকার মানুষের সঙ্গে ঐক্য।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘পাকিস্তানে ইমরান খানের দল নির্বাচনে-আন্দোলনে যেভাবে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে—বিএনপি তা পারেনি, সেটা করতে হবে।’ এর অর্থ, মির্জা ফখরুল স্বীকার করলেন যে, বিএনপির আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। ভবিষ্যতে এটা অর্জন করতে পারলে অন্য কোনো কিছু বর্জন করতে হবে না বলেই ধারণা করি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, মাছরাঙা টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খোঁজ মিলল রাইসির হেলিকপ্টারের, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২ কিমি দূরে উদ্ধারদল

পেকুয়া উপজেলা নির্বাচন / পড়ালেখায় এগিয়ে সজিব, অর্থসম্পদে আবুল কাসেম

রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি

‘রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের খোঁজ পাওয়া গেছে’

কোরবানির ঈদকে ঘিরে স্বপ্নপূরণের আশা খামারিদের

দুই বোনকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো ছাত্রলীগ নেতা পায়েল বহিষ্কার

বন্ধুর বাড়ি থেকে যুবকের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার

রাইসির ঘটনায় উচ্ছ্বসিত মার্কিন সিনেটর

সোমবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনিয়ে পালাচ্ছিলেন পুলিশ সদস্য

১০

রাইসিকে উদ্ধারকাজে বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে রাশিয়া

১১

রাইসিকে উদ্ধারের সর্বশেষ অবস্থা জানাল ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

১২

সংস্কারের দুদিন পরই উঠে যাচ্ছে কোটি টাকার কার্পেটিং!

১৩

বজ্রপাতে কলেজছাত্রের মৃত্যু

১৪

ঘুষ নিয়ে এএসআইয়ের দর-কষাকষির অডিও ভাইরাল

১৫

রাইসির খোঁজে যে ঘোষণা দিল এরদোয়ান

১৬

গণপিটুনির শিকার আ.লীগ নেতা

১৭

রাইসির খোঁজে এগিয়ে এসেছে যেসব দেশ

১৮

রাইসির খোঁজে ৩২ সদস্যের দল পাঠাচ্ছে তুরস্ক

১৯

ইরানের প্রেসিডেন্টের দুর্ঘটনাস্থল থেকে মিলল সংকেত

২০
X