মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
ড. সজল চৌধুরী
প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৬ এএম
আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান্ধব নগর উন্নয়ন

প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান্ধব নগর উন্নয়ন

আমরা যেখানে বসবাস করি কিংবা আমাদের বসবাসের স্থানের চারপাশে অনেক ধরনের মাইক্রো ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। কিংবা সবসময় বিদ্যমান থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এটি ক্ষতিকর কি না? আর ক্ষতিকর হলেও কীভাবে বসবাসের জায়গায় এ ধরনের মাইক্রো ব্যাকটেরিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে? বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনাভাইরাসের কথা। যার জন্য আজও বিশ্ব আতঙ্কিত। যে ভাইরাসের জন্য জনজীবনে নেমে এসেছিল দুর্ভোগ। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, জীবনযাপনের মান-সম্পর্ক সবকিছুতেই নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়। তাই আমাদের অবস্থানগত পরিবেশে জীবাণুর বিস্তার প্রতিরোধে স্থপতি পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলীদের কোনো কিছু করার প্রয়োজন আছে কি না, এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কারণ যখন কোনো জীবাণুর কথা আসে তখনই আমরা বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি ভাইরাল সাবান কিংবা বিশেষ কোনো ধরনের প্রতিষেধকের কথা ভাবি। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের ভাবতে হবে আমাদের বসবাসের জায়গাগুলোকে নিয়ে। কারণ এ জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের ঘরগুলো কিংবা বসবাসের জায়গাগুলো অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে সবসময়। অন্যদিকে আমরা এটাও জানি যে, প্রোবায়োটিক জীবাণুগুলোর উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধাও রয়েছে। এগুলো আমাদের পরিবেশে সর্বদাই উপস্থিত থাকে। হয়তোবা অনেকগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ও প্রয়োজনীয় হিসেবেও পরিচিত। তবে কিছু কিছু রোগজীবাণু আছে যেগুলো বসতবাড়িতে আমাদের খুব সহজেই অসুস্থ করে তুলতে পারে। এমনকি এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই কী কী জীবাণু আমাদের বসবাসের চারপাশে থাকতে পারে সেগুলো সম্পর্কে আমাদের জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। শুধু আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নয়, যা অন্যের স্বাস্থ্য সুরক্ষাও করবে।

এনএসএফ ইন্টারন্যাশনালের বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ-পূর্ব মিশিগানের বাইশটি পরিবারকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তারা দেখতে পান যে, ডিশ ওয়াশিং স্পঞ্জে সর্বাধিক পরিমাণ জীবাণু রয়েছে। তার পরে টুথব্রাশ হোল্ডার, রান্নাঘরের সিঙ্ক, কফি রাখার জায়গা, বিশেষ করে রান্নাঘরের কাউন্টার টপস, চুলার চারপাশ যেখানে অনেক সময় রান্না করার সময় খাবার পড়ে থাকে, খেলনা এবং টয়লেটের আসন স্থানগুলোতে সব থেকে বেশি পরিমাণ জীবাণু বংশবিস্তার করে। তা ছাড়া ময়লা রাখার জায়গা একটি বসতবাড়িতে সবসময় সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এসব স্থানে যে কোনো সময় জন্মগ্রহণ করতে পারে যে কোনো ধরনের জীবাণু। অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের একটি বড় দল যার নেতৃত্বে ছিলেন জর্দান পেসিয়া, যিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক ও পরিবেশগত প্রকৌশল অধ্যাপক; তিনি এবং তার দল ১৯৮টি বাড়ি থেকে নমুনা পরীক্ষা করেছেন ঘরের ধুলোয় অণুজীবের বৈচিত্র্য নির্ধারণের জন্য। গবেষকরা দেখতে পান যে, সর্বাধিক সাধারণ ছত্রাকের প্রজাতি হলো লেপটোসফেরুলিনা চর্টারিয়াম, এপিকোকাম নিগ্রাম এবং ওলেলেমিয়া সেবি। সর্বাধিক প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া ছিল স্ট্যাফাইলোকক্কাস, স্ট্রেপ্টোকক্কাস এবং কোরিনিব্যাকটেরিয়া পরিবার থেকে। এমনকি গবেষণা থেকে এটিও দেখা যায়, পোষা প্রাণীসহ এবং শহরতলিতে যারা বাস করেন তাদের বাড়িতে আরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রজাতি ছিল। এদিকে কোরিয়ার সিউল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন আমাদের রেফ্রিজারেটর এবং টয়লেটে বসার স্থানগুলো নিয়ে। তারা দেখিয়েছেন যে, সেখানে অধিক পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া রয়েছে এবং এ ব্যাকটেরিয়াগুলো অনেক মানুষের ত্বকের সঙ্গে খুবই সম্পর্কযুক্ত এবং প্রচুর পরিমাণ জীবাণুর উৎস, যা যে কোনো সময় মানুষকে বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন করতে পারে। সুতরাং আমাদের বসবাসের জায়গায় শোবার ঘর থেকে শুরু করে ড্রয়িংরুম, ডাইনিংরুম, কিচেন, টুথব্রাশ হোল্ডার সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের জীবাণু যে কোনো সময় জন্মাতে পারে। সব ধরনের জীবাণু সব ধরনের মানুষকে আক্রমণ করে না। আমাদের বসবাসের জায়গার সঙ্গে, আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে এ জীবাণুগুলোর সংক্রামিত হওয়ার অনেক উপায় রয়েছে। তাই স্থাপত্য নকশা বলি কিংবা যে কোনো ধরনের নকশা বলি অথবা জীবনযাপনের ধারা বলি না কেন, সেখানে আমাদের সুস্পষ্টভাবে খেয়াল রাখতে হবে এ বিষয়গুলোর দিকে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাড়ির শিশুদের এবং বয়স্কদের জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম। সময়ের আবর্তে আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই। এই তো মাত্র কয়েক বছর আগে সারা বিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। পৃথিবীতে লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়সই ষাটোর্ধ্ব। ভাইরাস আক্রমণের শিকার পৃথিবীতে বিগত শতাব্দীগুলোতেও বহুবার হয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় মানুষ এর থেকে নিস্তারও পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। উন্নত দেশগুলো তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিয়েছে। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলো এ ধরনের মহামারি মোকাবিলার পরবর্তী সময়ে সম্মুখীন হয় ভয়াবহ বাস্তবতার। এ ধরনের মহামারিতে সব থেকে বেশি হয় মানসিক সমস্যা, সেইসঙ্গে অর্থনৈতিক সামাজিক সমস্যা তো রয়েছেই। তবে এ কথা সত্যি যে, আমরা সময় থাকতে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি না। কিংবা কোনো একটি সমস্যা মোকাবিলার পরবর্তী সময়ে আমরা সেগুলোকে ভবিষ্যতে কীভাবে সমাধান করব সে নিয়ে আর আলোকপাত করি না। আমরা চলে যাই নতুন কোনো সমস্যার দিকে—এ পুরাতন সমস্যাগুলো যখন নতুনভাবে পরবর্তীকালে হানা দেয় তখন আমাদের তেমন কিছুই করার থাকে না সময়ক্ষেপণ করা ছাড়া। যদিও দুঃখের বিষয়, আমরা এখনো নিজেদের সঠিকভাবে সচেতন করে তুলতে পারিনি, যা আমাদের চলাফেরার মাধ্যমেই প্রকাশ পাচ্ছে। আর আমাদের এ ধরনের জীবনযাত্রা শুধু করোনাভাইরাস নয়, ভবিষ্যতে এর থেকে আরও বিপদের সম্মুখীন করে তুলবে। তাই সমস্যা থেকেই আমাদের নতুনভাবে শুরু করতে হবে, চিন্তা করতে হবে ভবিষ্যৎ নিয়ে। এটি প্রতীয়মান যে, বর্তমানে আমাদের স্থাপনা নির্মাণ বিধিমালায় নাগরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের মতো অধিক জনবহুল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে বসবাসের জায়গার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে ভাবতে হবে। সরকার থেকে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমন্বয় করতে হবে দেশের চিকিৎসক, স্থপতি, প্রকৌশলী, সমাজকর্মী, বিজ্ঞানী এবং পরিকল্পনাবিদদের। প্রস্তুত করতে হবে দেশের জন্য নতুন স্বাস্থ্যবান্ধব নগর উন্নয়ন বিধিমালা। স্থাপনা তৈরির বিধিমালাতে অন্তর্ভুক্তি করতে হবে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে। সময় থাকতে এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, না হলে অদূর ভবিষ্যতে আর সামনে তাকানোর কিছুই থাকবে না।

লেখক: স্থপতি, শিক্ষক ও স্থাপত্য

পরিবেশবিষয়ক গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঝালকাঠিতে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু

মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে প্রাণ গেল বৃদ্ধার

স্কুল থেকে ফেরার পথে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা

হাসপাতালে অজ্ঞাত নারীর লাশ, বিপাকে কর্তৃপক্ষ

ইসলামপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মৃত্যু

তীব্র তাপদাহে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্দেশনা

ভয়াল ২৯ এপ্রিলের স্মরণে ঢাকাস্থ কক্সবাজার সমিতি

মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যু

মঙ্গলবার কেমন থাকবে আবহাওয়া?

সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে নারীর জরায়ু কাটার অভিযোগ

১০

রাজবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পর্শে একজনের মৃত্যু

১১

বঙ্গবন্ধু মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন

১২

পাবিপ্রবিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন

১৩

বাজারে গিগাবাইটের এআই পরিচালিত ইন্টেল ১৪ জেনারেশন ল্যাপটপ

১৪

চিকিৎসা শেষে পথেই প্রাণ গেল ৪ জনের

১৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রাকচাপায় কলেজছাত্র নিহত

১৬

উপজেলা নির্বাচনে আ.লীগ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

১৭

এআইইউবিতে সিএস ফেস্ট

১৮

৩ সাংবাদিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সাইবার মামলা

১৯

উচ্চ শিক্ষায় ফিলিস্তিনের নারী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে আইইউবিএটি

২০
*/ ?>
X