মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০২:৩৫ এএম
আপডেট : ০৭ জুন ২০২৪, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোরবানির মর্ম ও শিক্ষা

কোরবানির মর্ম ও শিক্ষা

ইসলামের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব কোরবানির ঈদ। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে মহাসমারোহে পালিত হয় ত্যাগ ও আত্মত্যাগের ঈদ উৎসব। একই সঙ্গে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে সমবেত হন হজ পালনকারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সেখানে স্মরণ করা হয় হজরত ইব্রাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.) ও হাজেরা (আ.)-এর ত্যাগ এবং আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত। হজ, তওয়াফ, কোরবানি, জমজম, সাফা-মারওয়া, মিনা, জামরা—শব্দগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের স্মৃতি। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হিসেবে আমাদের ওপরও এসব শরিয়ত হিসেবে জারি করা হয়েছে। মুসলিমদের জীবনে কোরবানির আত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক প্রভাব সীমাহীন। আরবি শব্দ ‘কোরবুন’ থেকে এসেছে কোরবানি। যার অর্থ সান্নিধ্য, নৈকট্য, নিকটবর্তিতা, নাগাল ইত্যাদি। পরিভাষায় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১৩ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সুস্থ-সবল গৃহপালিত পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে। এই ত্যাগ ও উৎসর্গ শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিবেদিত হবে।

ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোরবানি করেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আপনি তাদের আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শোনান। যখন তারা উভয়ই কোরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি গৃহীত হয়েছিল এবং অন্যজনেরটা গৃহীত হয়নি।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-২৭)। আল্লাহ এখানে ‘কোরবান’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কোরবানির আরেকটি আরবি শব্দ হচ্ছে ‘নুসুক’। এর অর্থও ত্যাগ, উৎসর্গ ইত্যাদি। যেমন ‘আপনি বলুন—নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু আল্লাহরই জন্য।’ (সুরা আনআম, আয়াত-১৬২)। কোরবানির আরেকটি শব্দ হলো—নাহার। এর অর্থও উৎসর্গ। ‘অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাওসার, আয়াত-২)। এ কারণেই কোরবানির দিনকে ইয়াওমুন নাহার বলা হয়। তবে উজহিয়্যা, কোরবানি, নুসুক, নাহার—যে নামেই বলি, সবগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য কিন্তু এক। সেটা হলো ত্যাগ, উৎসর্গের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ।

কোরবানির ত্যাগ-উৎসর্গ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের একটি অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের জন্য আমরা আমাদের প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করি। মহান আল্লাহ আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বিধায় বান্দা হিসেবে আমাদের তার জন্য সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করতে হয়। সেটা করতে আমরা কতটুকু প্রস্তুত, সেই পরীক্ষাই মহান রব তার প্রিয় বান্দা ও রাসুল ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে নিতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাকে স্বপ্নে আদেশ করেছেন বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া এবং তরুণ বয়সে উপনীত হওয়া সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে জবাই করার জন্য। একই স্বপ্ন ইব্রাহিম (আ.) তিন দিন দেখার পর প্রিয় সন্তান ইসমাইলকে বলেন, ‘হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার মত কী? তিনি বললেন, হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্য ধারণকারীদেরও অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০২)। এখানে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, দুই নবী যারা পিতা-পুত্রও বটে, তারা একজন আরেকজনকে জবাই করার কথোপকথন করছেন। পিতা বলছেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে জবাই করছি। জবাবে জবাইয়ের শিকার হতে যাওয়া পুত্র বলছেন, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন। নবী-রাসুলগণের স্বপ্নও ওহি এবং আল্লাহর আদেশ পালন করা জীবনের চেয়েও বেশি দামি পিতা-পুত্র দুই নবী তাই প্রমাণ করলেন। ইব্রাহিম (আ.) ইসমাইল (আ.)-কে বেঁধে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালানোর সময় ধারালো ছুরি কাজ করছিল না। ‘তখন আমি তাকে ডেকে বলি—হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। এভাবে আমি সৎকর্মীদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম জবাই করার এক মহান জন্তু।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০৫-১০৭)।

যুগে যুগে প্রত্যেক জাতির জন্যই কোরবানির বিধান ছিল। বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির বিধান করে দিয়েছি। তিনি জীবনোপকরণের জন্য যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৪)। কিন্তু বর্তমানে যে কোরবানি প্রচলিত, সেটা শুরু হয়েছে ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর মাধ্যমে। আমাদের সৌভাগ্য, আল্লাহ ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন এবং দুজন মহান পয়গম্বর সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আমাদের জন্য ত্যাগ-উৎসর্গের পথ সহজ করে দিয়ে গেছেন।

কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাকওয়া অর্জন। আর কিছুই না। কারণ উপহার-উৎসর্গ যার জন্য করা হয়, তিনিই সেটা ভোগ করেন। কিন্তু কোরবানি এবং আল্লাহর নামে অন্যান্য উৎসর্গের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। এখানে যার জন্য উৎসর্গ করা হয়, তিনি ছুঁয়েও দেখেন না, বরং কোরবানিকারী নিজেই তা ভক্ষণ করেন এবং আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করেন। সেটাও আল্লাহর নির্দেশেই। তিনি বলেন, ‘এবং কাবার নামে উৎসর্গকৃত উটকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় তাদের জবাই করার সময় তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায়, তখন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও যে কিছু যাচ্ঞা করে না তাকে এবং যে যাচ্ঞা করে তাকে। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু তার কাছে পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করো এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎ কর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সুরা হজ, আয়াত ৩৬-৩৭)। এখানে কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা বর্ণনা করার পাশাপাশি কোরবানির গোশতের বণ্টনের নিয়মও আল্লাহ বলে দিয়েছেন। কোরবানির গোশত নিজের, হাত পাতা ভিক্ষুকের এবং হাত না পাতা সম্ভ্রান্ত আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর। তাই কোরবানির গোশতকে আমরা তিন ভাগ করে থাকি।

কোরবানি কবুল হওয়ার জন্য তাকওয়া তথা অন্তরের সুপ্ত বাসনাই হচ্ছে আসল। আল্লাহ বলেছেন, তার কাছে রক্ত-মাংস পৌঁছায় না। কিন্তু তার কাছে যায় মনের তাকওয়া। মুসলিম শরিফে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ‘তাকওয়া এখানে’ তিনবার বলে কলবের দিকে ইশারা করেছেন। তাকওয়া অর্জনের জন্য পরিপূর্ণভাবে খাঁটিমনে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য হতে হবে কোরবানি। ‘মানুষ কী বলবে’, ‘আমার সন্তান কার দরজায় যাবে’—এমন চিন্তা যদি কোরবানির উদ্দেশ্য হয় তবে গোশত খাওয়াই হবে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য, তাকওয়া অর্জন হবে না। আর যদি আল্লার সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তবে আপনার-আমার কোরবানির গোশত অন্য কোথাও চলে যাবে না। ইসলামে লোকদেখানো ইবাদতের কোনো স্থান নেই। মুসলমানের প্রতিটি কাজ হতে হবে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আল্লাহকে দেখানোর উদ্দেশ্যে। মানুষের প্রশংসা বা লোকদেখানো ইবাদত-বন্দেগিকে এত বেশি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে যে, রিয়া তথা লোকদেখানো কর্মকে শিরকে খফি বা ছোট শিরক বিবেচনা করা হয়েছে ইসলামে।

কোরবানি ইসলামের অন্যতম নিদর্শন। কোরবানির জন্য প্রস্তুতকৃত পশুকে কোরআনে আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে এবং এ নিদর্শনকে সম্মান করাকে অন্তরের তাকওয়া বলে অভিহিত করা হয়েছে। সর্বোপরি, তাকওয়ার বাইরে কোরবানিতে রয়েছে সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণ। হাত পাততে না পারা এবং হাত পাততে পারা মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার জোগান হয় কোরবানির মধ্য দিয়ে। কোরবানি না করে এ দুই শ্রেণির মানুষকে যদি কেউ অর্থ দান করে, তবে কতটুকু করবে? এক-দুই কেজি খাসি বা গরুর গোশত কিনে দেওয়া বা কিনে খাওয়ার পয়সাদানের মতো মানসিকতা কতজনের আছে? ভিক্ষকের প্রতি মানুষের আচরণ তো সবারই জানা। কিন্তু কোরবানি উপলক্ষে তারা মেহমানের মর্যাদা পায়। ইসলামের অন্যতম উত্তম একটি কাজ হচ্ছে অন্যকে খাওয়ানো। উত্তম কাজ কোনটি—এক সাহাবির প্রশ্নের জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, তুমি অন্যকে খাবার খাওয়াবে এবং চেনা-অচেনা লোকদের সালাম দেবে।’ (বোখারি)।

তাকওয়া অর্জন, পুষ্টিকর খাবার ও নগদ অর্থ (পশুর চামড়ার) দান-বহুবিদ কল্যাণ রয়েছে কোরবানিতে। জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সময়ের মধ্যে সুস্থ মস্তিষ্ক ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কাছে দৈনন্দিন অপরিহার্য খরচের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ অর্থ থাকলে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব হবে, অন্যথায় নয়। আল্লাহ আমাদের বোঝার ও আমলের তওফিক দান করুন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৩১ দফার বার্তা প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে : সেলিমা রহমান

এসএ২০ নিলামে সাকিব–মোস্তাফিজসহ ১৪ ক্রিকেটার

প্রবাসী বাংলাদেশির মেয়েকে হত্যায় ইতালিতে বিক্ষোভ

সংঘর্ষের ৪৪ ঘণ্টা পর মামলা করতে থানায় চবি প্রশাসন

চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাসহ ১৮২ জনের বিরুদ্ধে মামলা

হেসে খেলে ডাচদের হারিয়ে সিরিজ জিতে নিল টাইগাররা

‘জনগণের ভালোবাসা ও আস্থার ভিত্তিতে বিএনপি বারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এনসিটিবির কড়া সতর্কতা

উমামা ফাতিমার সংবাদ সম্মেলন বয়কট মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকদের

মহাখালী ক্যানসার হাসপাতালে ১ কোটি টাকা অনুদান দিল জামায়াত

১০

চবি ক্যাম্পাসে ১৪৪ ধারা জারি, সময় বাড়ল আরও একদিন

১১

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা ফ্রি হবে : খসরু

১২

ডাকসু নির্বাচনে শিবির সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহার ঘোষণা

১৩

ঘুম থেকে উঠেই বিছানা পরিষ্কার করা ভালো নাকি খারাপ, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

১৪

নৌ-পুলিশের অচল স্পিডবোটের জন্য বরাদ্দ ২০০ লিটার তেল!

১৫

‘আমি নাকি গে!’ গুঞ্জন উড়িয়ে দিলেন অক্ষয় কুমার

১৬

আড়াই ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ ট্রেন চলাচল শুরু

১৭

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরীক্ষায় জালিয়াতি, প্রতারক গ্রেপ্তার 

১৮

মুন্সীগঞ্জে একদিনেই মিলল তিন মরদেহ

১৯

ছাত্র মজলিসের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রহমত আলী আটক

২০
X