দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের। বিশেষভাবে বলতে হয়, চলমান অর্থনৈতিক সংকটকালে তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সই অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে—এটি যেমন সত্য; অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের শোষণ ও ভোগান্তির চিত্র এবং তা নিরসনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে যথাযথ ভূমিকা বা দায়িত্ব পালনের বিষয়টি বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ, যা নিঃসন্দেহে বেদনার এবং হতাশার। শনিবার কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এবং তার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী এক বাংলাদেশি কর্মীর করুণ ও মর্মন্তুদ পরিস্থিতি প্রবাসীদের দুর্দশা ও অন্যায়ের শিকার হওয়ার বিষয়টিকে আবারও সামনে এনেছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার বাংলা গ্রামের বাসিন্দা মাহাবুব আলম। অনেকের মতো তারও স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে টাকা আয় করবেন। দুঃখের দিন শেষ হবে, হাসি ফুটবে পরিবারের সবার মুখে। সেই আশায় শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করে বৈধভাবেই তিনি মালয়েশিয়া যান। তার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। উল্টো তিনি এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মিথ্যা মামলার দণ্ড মাথায় নিয়ে হাসপাতালে কাটছে তার জীবন। চিকিৎসাধীন মাহাবুবকে একটি ভিডিওতে দেখা যায়, তার শরীর হাড্ডিসার। অসুস্থতায় চুল পড়ে গেছে। মাথায় রয়েছে একাধিক ক্ষতচিহ্ন। হাসপাতালের পোশাকে তিনি বারবার চোখ মুছছেন। মাহাবুবের স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, বৈধভাবে মালয়েশিয়া গিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হন মাহাবুব। জানা যায়, ২০২৩ সালে মালয়েশিয়া যান মাহাবুব আলম। তার রিক্রুটিং এজেন্সির নাম ‘সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনাল’। শর্তানুযায়ী সেখানে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ওয়ার্ক পারমিট নিশ্চিত করাসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথা। কার্যত তা হয়নি। শর্ত ভঙ্গ করে ছয় মাসের অধিক সময় আট শতাধিক কর্মীকে বসিয়ে রাখা হয়। এ পরিস্থিতিতে তারা মালয়েশিয়ায় আইনি লড়াইয়ে নামলে মাহাবুবসহ ছয়জনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। শুধু মাহাবুব নন, বিশ্বের নানা দেশে তার মতো অনেক প্রবাসী মাহাবুব আছেন, যারা বিভিন্ন সময় নানা রকমের ভোগান্তির শিকার হন। এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই দেশের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতদের উদাসীনতার নজির কারও অজানা নয়। শুধু কি বিদেশ, দেশ থেকেও এসব কর্মী যখন বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকেন, তাদের সঙ্গেও কী ভয়ানক অন্যায় সংঘটিত হয়, সেটা সবার জানা। অতি সম্প্রতি দেশের প্রায় ১৭ হাজার কর্মীর বৈধ ভিসা ও কাজের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও তারা মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। এ ঘটনায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়িত্বশীল ছিলেন না এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেননি—এটিই সত্য। তার জন্য ভুগতে হচ্ছে এ শ্রমিকদেরই। পরে এ ঘটনাকে প্রধানমন্ত্রী ‘দেশের জন্য বড় ক্ষতি’ উল্লেখ করে যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তাকে সাধুবাদ জানাই।
আমরা মনে করি, জনশক্তি রপ্তানি এবং প্রবাসীদের সেবায় রাষ্ট্র, সরকার ও সংশ্লিষ্টদের আরও আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। প্রবাসীদের ভালো-মন্দের খোঁজখবর রাখা এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব প্রথমেই বর্তায় সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশি দূতাবাসের ওপর। তাদের উচিত আরও দায়িত্ববান হওয়া। কেননা তাদের দায়িত্বশীলতা নানা সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই দেশের এজেন্সির মধ্যে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যথাযথ নজরদারি বৃদ্ধিসহ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বিকল্প নেই। এ দুটি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। আমাদের চাওয়া, জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে শ্রমিকের ভোগান্তি হ্রাসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাসহ প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হবেন।