বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বহুল প্রচলিত দুটি প্রবাদ বাক্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর একটি হলো—‘শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা’; আর অন্যটি—‘শুঁটকির হাটে বিড়াল চৌকিদার’। চোর ডাকাতের কাছে কোনো কিছু আমানত রাখলে এ প্রবাদ বাক্য দুটি উল্লেখ করা হয়। প্রবাদ বাক্য শুধুই কথার কথা নয়, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ কোনো গভীর জীবনবোধ লোকপ্রিয় সংক্ষিপ্ত উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এই ছন্দবদ্ধ কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চেহারার প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ উন্মোচিত হয় প্রকৃত রূপ ও স্বরূপ।
জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা। ‘আকাশে শান্তির নীড়’ স্লোগানে যাত্রা শুরু করা এ সংস্থা সাধারণ মানুষের কাছে বিমান নামেই সমধিক পরিচিত। যাত্রীরা জানেন, এটি আদৌ শান্তির নীড় কি না। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সংস্থাটির আয় যে কমে আসছে, বরাবরই লোকসান করছে; এটি গণমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ মানুষও জানে। বুধবার কালবেলায় প্রকাশিত ‘চুক্তি কারসাজির গচ্চা দিচ্ছে বিমান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইনে টিকিট কেনাবেচাসহ বিভিন্ন সেবা ক্রয়ের চুক্তিতে কারসাজির কারণে হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে এই জালিয়াতির মাধ্যমে ১০ বছরে অতিরিক্ত ১ হাজার ৭৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেবার গ্লোবাল ইনকরপোরেশন। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। চুক্তির বিস্তারিতসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করে এরই মধ্যে বিমানের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নানাবিধ কারণে সংস্থাটি বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে চলছে। মূলত অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি, মাথাভারী প্রশাসনসহ প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি লোকবলের কারণে বিমানকে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান দিতে হচ্ছে। পেশাগত দক্ষতা বাড়াতেই জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০০৭ সালে কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়। কোম্পানি করার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করা। কিন্তু গত প্রায় দুই দশকে দক্ষতা বাড়ার বদলে আরও অবনতি হয়েছে। বিমান আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রুটে অনেকগুলো বেসরকারি বিমান পরিবহন চালু হওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিমান ব্যবসা হারাচ্ছে না, সংস্থাটি ব্যবসা হারাচ্ছে অনিয়ম, অব্যবস্থা ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারায়। সংস্থাটির সেবার মান বৃদ্ধির কোনো প্রয়াস নেই। ফলে পারতপক্ষে কেউ বিমানের যাত্রী হতে চান না। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে হলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার বিকল্প নেই। এদিক থেকেও বিমানের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অদক্ষতা, অযোগ্যতা আর দুর্নীতি এ সংস্থাটির পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতিযোগিতায় বিমানের পিছিয়ে পড়ার এটাই অন্যতম কারণ। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত বিমানের লোকসানের ভার বইতে হয় জনগণকেই।
আমার মনে করি, প্রায়ই দেশের বিভিন্ন খাতের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর বাইরে নয়। যাদের হাতে বিমানের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তারাই নিজেদের হীনস্বার্থে কারসাজির মাধ্যমে সংস্থাটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার তৎপরতায় লিপ্ত। আমাদের প্রত্যাশা, যাদের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে তাদের আইনের আওতায় বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। তবেই বিমানের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।