সরকারের কিছু পূর্বানুমানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবারের বাজেট। সরকার ধরে নিয়েছে এখন যেভাবে রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে। আরেকটা পূর্বানুমান হলো, টাকার মূল্যমান আর বাড়বে না। সরকার ধরে নিয়েছে ঋণের প্রবাহ কমানো হবে এবং সুদের হার বাড়ানো হবে, তাতে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু সুশাসন ছাড়া এ পূর্বানুমানের কোনোটিই কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়। যেহেতু সুশাসনের ঘাটতি প্রকট তাই এগুলোর কোনোটাই পরিপূর্ণভাবে এবং ইচ্ছা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হবে না। সুতরাং সংকট কমে যাবে বা থেমে থাকবে বলে বাজেটে যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, তা পূরণ হবে না।
সরকার প্রত্যাশা করছে, চলমান ১০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি আগামী অর্থবছরে ৬ শতাংশ নেমে যাবে। আমদানিতে ডলারের বিপরীতে এরই মধ্যে যেভাবে টাকার মান পড়েছে, তাতে মুদ্রাস্ফীতি কমার এ প্রত্যাশাও পূরণ হওয়ার লক্ষণ নেই। ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৩৩ শতাংশের বেশি পড়ে গেছে। ফলে সব আমদানি দ্রব্যের দাম ৩৩ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ বাড়তি দাম সহজে কমবে না। সরকার এসব পণ্যের দাম কমার আশা করলেও তা সম্ভব নয়।
আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটে সরকারের সেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল যাতে ইকোনমি বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, প্রবৃদ্ধি বাড়ে। এর পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু এ দুটো দিকে সরকার গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সরকারের প্রত্যাশিত সুফলগুলো মিলবে না। অর্থনীতির কুফলগুলোকে যা দিয়ে ঠেকানো যেত তার অনুপস্থিতিতে বিপদ আরও বাড়বে।
পক্ষান্তরে নৈতিক দিক থেকে এবং অর্থনৈতিক বিবেচনায় কোনোভাবেই কালো টাকাকে সাদা করার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। ১৫ শতাংশ করের বিনিময়ে কালো টাকাকে সাদা করার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে খুব বেশি কালো টাকা সাদা হবে সেটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আজও এটা হয়নি, পরেও হবে না। উপরন্তু এখন পর্যন্ত যারা ট্যাক্স পরিশোধ করত, যারা সাদা টাকা রাখত, তারা ট্যাক্স শোধ না করে কালো টাকা রাখতে উৎসাহিত হবে। সুতরাং শিষ্টের পালন এবং দুষ্টের দমন না হয়ে এখানে দুষ্টের পালন এবং শিষ্টের দমনে পরিণত হবে।
বাজেটে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বরং পরোক্ষ কর জনগণের ওপর আরও বেশি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরোক্ষ কর বাড়ানো মানে জনগণের মাথায় বোঝা বাড়ানো। শুল্ক কমানো হয়েছে অল্প কয়েকটি পণ্যে এবং এমন সব পণ্যে যার শুল্ক বাড়ানো বা কমানোতে মানুষের তেমন কিছু আসে যায় না। এর বাইরে বাজারের বিশৃঙ্খল অবস্থা আছেই। শুল্ক কমানোর এ সুবিধাটুকু মধ্যস্বত্বভোগীরাই খেয়ে ফেলবে। অন্যদিকে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে সেসব পণ্যে বা জায়গায় যার সরাসরি প্রভাব পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর।
সরকার যে ঘাটতি বাজেট দিয়েছে এবং যেভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বলেছে, তাতে প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাংকে আর টাকা থাকবে না। আর ব্যাংক বেসরকারি খাতকে টাকা দিতে না পারলে বিনিয়োগ কম হবে ও প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। সংকোচনশীল সরকারি ব্যয় ও সংকোচনশীল প্রাইভেট বিনিয়োগ সবমিলিয়ে কর্মসংস্থান এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি—দুটোই কম হবে।
সরকারের বাজেটের ৬০ শতাংশ চলে যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। জনপ্রশাসন ও ঋণ পরিশোধে বাজেটের অর্ধেক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাকি মাত্র ৪০ শতাংশ উন্নয়নশীল খাতে। আর বাজেটের এই ৪০ শতাংশের বিতরণ একদমই গতানুগতিক। গত বছরের বাজেট প্রস্তাব এবং এ বছরের বাজেট প্রস্তাব কিছু জায়গায় এদিক-ওদিক করা ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। আমরা বলেছিলাম শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সুরক্ষা—এ তিনটি জায়গায় সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কিন্তু সরকার আমাদের কথা শোনেনি।
বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা, সম্পূর্ণ বাজেট ব্যয় করতে না পারা। কোনো বছরই সরকার বাজেটের ৮৫ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে পারে না। চলতি অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও কম। আগামী বাজেটেও যদি এভাবে কমে এবং সেটা যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতেই কমে, তবে সেটা হবে আত্মঘাতী।
আমরা দেখি প্রত্যেক বাজেটে সরকার আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কোনো বছরই তা পূরণ করতে পারে না। এ আয়ের লক্ষ্য পূরণের জন্য সরকারের উচিত ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যান্য কারণে চিহ্নিত অপরাধীদের ধরে একটি বার্তা দেওয়া। এটা বোঝানো যে, আমরা সবার কাছ থেকে কর আদায় করব। সম্পদ কর ও প্রত্যক্ষ করের নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত ছিল। সেই ব্যবস্থার মাধ্যমে যারা কর ফাঁকি দিত তাদেরও এর আওতায় আনা যেত। কিন্তু তা না করে এখন যারা কর দেয়, তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে কর না দিয়ে কালো টাকা রাখতে! কারণ তারা দেখছে, কালো টাকা পরে সাদা করা যাচ্ছে অল্প করের বিনিময়ে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সম্পূর্ণ কর ব্যবস্থার মধ্যে কর প্রদানে উৎসাহিত করার কোনো পদক্ষেপ নেই।
সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে কথা বলছে, তা করতে হলে পাবলিক সার্ভিসগুলোতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা উচিত ছিল। একই সঙ্গে দরিদ্রদের ৪০ শতাংশ আয় সহায়তা দেওয়া দরকার ছিল, যাতে মূল্যস্ফীতি না কমলেও তারা যেন টিকে থাকতে পারে। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য কার্ডের মাধ্যমে রেশনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। এসব খাতের কোনোটিতেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বাজেটে। সুতরাং এবারের বাজেটকে আমি কোনোভাবেই জনকল্যাণমুখী বলতে পারি না।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়