সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার ও বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. গোলাম সাকলায়েনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনকে (পিএসসি) জানানো মতামতে ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে পুলিশের এ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার জন্য বলেছে মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি পিএসসিতে পাঠানো এক চিঠিতে এ মতামত জানানো হয়েছে।
নায়িকা পরীমণির সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ার অভিযোগে সাকলায়েনকে এ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের ৯ জুন রাতে সাভারে ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ১৪ জুন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন পরীমণি। সেই মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছিলেন ডিএমপি ডিবির গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাকলায়েন। মামলাটি তদারকি করার সময় বাদী পরীমণির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান এ কর্মকর্তা।
দুই. ছাগলকাণ্ডে আলোচিত মতিউর রহমানের অর্থ পাচারসংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের কাছে তার ব্যক্তিগত নথি ও চাকরি জীবনে উত্তোলিত বেতন-ভাতার বিবরণ, অফিসিয়াল লোন গ্রহণ বা পরিশোধসংক্রান্ত তথ্য ও তার স্ত্রী, পুত্রের নামে ব্যবসা পরিচালনা-সংক্রান্ত অনুমোদনের রেকর্ডপত্র চেয়েছে দুদক। ছাগলকাণ্ডের পর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে মতিউর রহমানের দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পত্তির তথ্য। এ কারণে এনবিআরের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনাল থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয় মতিউরকে। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে।
তিন. এ খবরগুলো এখন মিডিয়াজুড়ে। প্রতিদিন এমন সব খবর আর ফলোআপের চাপে আছে জনগণ। বাংলাদেশ থেকে ফিরেছি এ মাসেই। স্বল্প সময়ের জন্য গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি মানুষ কেমন আছে। জনগণ আসলে রাজনীতি বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। যে দুটি বিষয় তাদের ভাবিত করে তার একটি বাজারদর অন্যটি দুর্নীতি বা দুঃশাসন। বাজারদর নিয়ে সবার মনে চরম অসন্তোষ। আন্তর্জাতিক বাজারদর আর যুদ্ধের কথা মানুষ জানে। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যের দামের অস্বাভাবিক ওঠানামা বোঝে না তারা। তারপরও সবার ওপরে আছে এসব খবর। মিডিয়ার চোখে নেগেটিভ খবর প্রাধান্য পাবে এটাই নিয়ম। টিভি চায় দর্শক, রেডিও চায় শ্রোতা, সংবাদপত্র বা অন্য মিডিয়ার দরকার পাঠক। এসব মিডিয়াজুড়ে এখন শুধুই নেগেটিভিটির জয়জয়কার। স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনাগুলো ঘটছে বলেই খবর হচ্ছে। কিন্তু এক-একটা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। হঠাৎ করে আলাদিনের চেরাগ ঘষার মতো সম্পদ আসে কোথা থেকে? বা এই যে প্রেমকাণ্ড, তাও কি হঠাৎ কিছু?
যারা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করেন, দেশ চালান তারা এগুলো ভালো বুঝবেন। ভালো জানবেন। আমার মনে হয়েছে, সময় ও সুযোগমতো এক-একটা ঘটনা সামনে আসছে। তারপর সেটা নিয়ে হৈচৈ চলছে। কিছুদিন পর মতিউরকে সবাই ভুলে যাওয়ার মতো আরেকটি ঘটনা এলেই কেল্লাফতে। তখন ন্যাড়া মাথা মতিউর আবার পুরো মাথা চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও কেউ কেয়ার করবে না। পরীমণির সঙ্গে প্রেমও তেমনি একটি মৌসুমি আবহাওয়ার ঝড়। সময়মতো আসে আবার চলে যায়। পরীমণি কম ঘটনার জন্ম দেননি। হয়তো আরও দেবেন। আসল কথা হলো, প্রেম করার অধিকার মৌলিক। কিন্তু কে, কীভাবে, কোথায় তা করছেন আর সমাজ সংসারে কী তার প্রভাব? যদি সে বিবেচনায় এটি অপরাধ হয় তো সেজন্য একজন দায়ী হন কীভাবে? প্রেম বা শারীরিক সম্পর্ক কি একজনে হয়? আগেই বলেছি, আমরা আমজনতা এসব হিসাব বুঝব না। মাথায়ও ঢুকবে না।
যে কথা বলতে চাই, এই যে একটার পর একটা নেগেটিভ নিউজ এবং তার যে রমরমা অবস্থা, জনগণ বিশেষত তরুণ-তরুণীদের মনে এগুলো কী ধরনের প্রভাব ফেলছে? মানুষের মন বা চিন্তার স্তর বিশ্লেষণ করলেই জানা সম্ভব কোন বয়সে তা পাকা ছাপ ফেলে আর কোন বয়সে তার ছাপ স্থায়ী হয় না। কোটি কোটি তরুণ-তরুণী বা তার নিচের বয়সীদের জন্য এগুলো সাংঘাতিক খারাপ সংবাদ। আজকাল অবারিত মিডিয়ায় সবকিছু হাতের মুঠোয়। সমাজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, যেখানে তারা বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা, জাহানারা ইমামদের চেনে না। জানে না ইতিহাস ঐতিহ্য। কিন্তু তাদের নরম কোমল মগজের কোষে ঢুকে আছে পরীমণি। ঢুকে আছে মতিউররা। এর ফল বিষবৎ হতে বাধ্য।
নেগেটিভিটির কথাই যখন উঠল তখন ক্রিকেটের কথায় আসি। সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে আমাদের দেশ। আশা-ভরসা আর উৎসাহের জলে ভাটা পড়ে গেছে। সবার স্বপ্ন আর ভালোবাসাকে কাঁচকলা দেখিয়ে সুপার লিগে সব খেলায় পরাজিত দেশের ক্রিকেট টিম আরেক নেগেটিভ উদাহরণ। যেসব খেলোয়াড়ের দিন শেষ, দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের দলে রাখলে এমন হবেই। যেসব তরুণ ঝলসে উঠতে চেয়েছে, তাদের দু-একজনের আচরণগত সমস্যা এখন বিশ্বজুড়ে সমালোচিত। দেশের বাইরের মিডিয়ায় চোখ পাতলেই দেখবেন সুধীজনরা এ আচরণগত ঔদ্ধত্য ভালোভাবে নেননি। মনে রাখতে হবে দিনশেষে খেলা খেলাই।
যাদের সম্মান আর মর্যাদা বেশি সেটা এমনি এমনি পায় না তারা। এজন্য তাদের লড়তে হয়েছে। তাদের অগ্রজরা লড়াই করে সুনাম অর্জন করেছিল বলেই লোকে তাদের ভালোবাসে। আমাদেরও সেটা মাথায় রাখতে হবে। জোশ বা উল্লম্ফন করা যেতেই পারে, কিন্তু তাতে আখেরে দেশের লোকসান। ভাবমূর্তির অপমান। কোনো ইতিহাস, এমনকি দেশ-কাল-পাত্র ছাড়া দেশ আফগানিস্তান ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে জায়গা করে নিচ্ছে, সমীহ আদায় করে চলেছে। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আক্রমণাত্মক হলেও আগ্রাসী নয়। এটা শেখার দরকার আছে। নয়তো সময় আমাদের আরও ভোগাবে। জয়-পরাজয়ের বাইরে বাংলাদেশ খারাপ খেলেনি। খারাপ করেছে, হতাশ করেছে, আচরণ আর সময়মতো ঝলসে উঠতে না পারায়।
যে কথা বলছিলাম; এত নেগেটিভিটির ভেতর বসবাস করা সমাজের নাগরিকরা পজিটিভ থাকবেন কীভাবে? বিশেষ করে বড় হয়ে ওঠা নাগরিক যারা আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের সামনে কী দৃষ্টান্ত রাখছে সমাজপতি নামে পরিচিতজন বা সেলিব্রেটিরা? কেউ টাকায় মজে পাপ করে, কেউ সম্পদের লোভে দেশের বারোটা বাজায় আবার কেউ খেলার নামে দেশের সম্মানহানি করে, কেউবা ভালোবাসার নামে করে প্রতারণা। এসব ডামাডোলে পথ হারানো সহজ। কঠিন, সত্য আর সুন্দরে থাকা। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি আজ নন্দিত। বাংলাদেশ তার পুরোনো ইমেজের বাইরে শক্তিশালী অর্থনীতির এক দেশ। যার ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই আশাবাদী। সে কারণেই আমাদের দরকার সুস্থ মনমানসিকতার তারুণ্য। আজকাল সমাজে সে বিষবাষ্প যে পরিমাণ অন্যায় আর লোভের খবর তাতে আতঙ্কিত হওয়ার বিকল্প দেখি না। ভরসা একটাই, মূলধারা এখনো সচল। হয়তো তারা প্রোপাগান্ডা বা খবরে পিছিয়ে, কিন্তু তারাই আলো। তারাই ভরসা। এত নেগেটিভিটি কবে দূর হবে?
লেখক: সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক ও ছড়াকার