রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়েও ডা. জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দেওয়া সাজাকে একটি ‘বার্তা’ হিসেবে দেখছে বিএনপির হাইকমান্ড। এ বিষয়ে গত সোমবার দলটির সর্বোচ্চ র্নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। স্থায়ী কমিটির নেতারা মনে করছেন, এ রায় ক্ষমতাসীনদের দুরভিসন্ধির একটি অংশ। দলের নীতিনির্ধারকদের অভিযোগ—বিএনপিকে ‘জিয়া পরিবারমুক্ত’ ও ‘নেতৃত্বশূন্য’ করার অপপ্রয়াসের অংশ হিসেবে তারেকের সঙ্গে ডা. জুবাইদাকেও ‘মিথ্যা মামলায়’ সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত সোমবার দলের নিচু সারির ২৭ নেতাকে সাজা দেওয়ার ঘটনায় সরকারের নীলনকশা দেখছেন বিএনপির হাইকমান্ড। দলটি বলছে, তারা যেন আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সেজন্য নেতাকর্মীদের সাজা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে, গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির বিষয়ে এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে মাঠের নেতাদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক করছেন বিএনপির হাইকমান্ড।
উল্লেখ্য, গত ২ আগস্ট জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৯ বছরের কারাদণ্ড হয়। একই মামলায় তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং তার সহধর্মিণীর বিরুদ্ধে রায় প্রদানে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এ রায়কে তারা ফরমায়েশি বলে দাবি করেছেন। সভা মনে করে, বর্তমান অবৈধ সরকার, বিচার বিভাগকে অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসনকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিচার বিভাগের সব স্তরকে দলীয়করণের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে দেশের জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকারী তারেক রহমান, তার স্ত্রী অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ডা. জুবাইদা রহমান, বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দুদক ও দলীয় পুলিশ কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা মামলার বেআইনি ফরমায়েশি রায়, নিম্ন আদালতের স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চলমান আন্দোলন দমন করার জন্য ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সভা মনে করে, সরকারের আজ্ঞাবহ দুদকের মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং বিশেষ করে অরাজনৈতিক ব্যক্তি ডা. জুবাইদা রহমান দণ্ডিত হওয়ায় প্রমাণ করে যে, বিএনপির আন্দোলন দমন করার জন্যই এ রায়।
সভায় বিচারকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। সভায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ডা. জুবাইদা রহমানসহ সাজাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতার রায় বাতিল এবং সব মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তারেক রহমান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে যে ফরমায়েশি রায় দেওয়া হয়েছে, তা সরকারপ্রধানের হিংসা ও আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ। তারেক রহমানের নেতৃত্বে জনগণের মাঝে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের দাবানলকে বিভ্রান্ত করতে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের এটি একটি কূটচাল। একদফার আন্দোলনকে নেতৃত্বশূন্য করতে আদালতের ঘাড়ে বন্দুর রেখে প্রতিহিংসা মেটানো হয়েছে। তিনি বলেন, এটি একেবারে পরিষ্কার যে, এসবের একটা লক্ষ্য হলো সরকার তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেওয়া এবং আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে একদফার যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশদ্বারে গণঅবস্থান কর্মসূচির মূল্যায়ন করতে সেদিন রাজপথে থাকা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বক্তব্য শুনছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাদের কাছ থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন—অবস্থান কর্মসূচিতে কোথায় কী ধরনের অসংগতি ছিল, এখন কী করা যায়। এ সময় যার যে সামর্থ্য, সে অনুযায়ী কথা বলা ও কাজ করার পরামর্শ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে অবস্থান কর্মসূচিতে কথা ও কাজের মিল না থাকায় নেতাদের তিরস্কারও করেছেন তিনি।
সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, অবস্থান কর্মসূচি থেকে দল যা অর্জন করেছে, তা আগামীদিনের আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে, পুলিশের কঠোর মনোভাব দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ভালোভাবে নেয়নি, সেটি তারা বিবৃতি দিয়ে বুঝিয়েছেনও। পাশাপাশি বিএনপির বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাস-সহিংসতা’ সৃষ্টির যে অভিযোগ সরকারের দিক থেকে বিভিন্ন সময়ে করা হয়, তাও এই অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে দূর করা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে সরকারের পতনের চলমান আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এই আন্দোলন এখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, সরকারের মনোভাব আরও কঠোর হবে। এমন পরিস্থিতিতে রাজপথে আন্দোলন জোরদারে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংঘবদ্ধ করতে চাইছে দলটি। সে লক্ষ্যেই জামায়াতে ইসলামীসহ সরকারবিরোধী ডান, বাম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তা দৃশ্যমানও হয়েছে। গত রোববার বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ যুগপৎ আন্দোলনে থাকার ঘোষণাও দিয়েছেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, দেশের গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, আইনের শাসন ও মানবাধিকার ফেরাতে সবাইকেই রাজপথে দেখতে চাই। এ নিয়ে অনেকের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা চলছে। ডান-বামসহ সব রাজনৈতিক দলকে নিয়েই চলমান আন্দোলন সফল করা হবে।
মন্তব্য করুন