রাজধানীর মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে স্ত্রী-সন্তানসহ প্রবাসী মনির হোসেনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। খাবারে বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হতে পারে—পুলিশ এমন ধারণা করলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। মনির হোসেনের ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাড়ির কেয়ারটেকার রফিকুল ইসলামকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করলেও তার সম্পৃক্ততার এখনো কোনো প্রমাণ মেলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে উপস্থাপন করে রিমান্ড আবেদন করে। শুনানি শেষে তার দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট।
একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর এ ঘটনায় রমনা থানায় মামলা হয়েছে। নিহতের ভাই নুরুল আমিন মামলাটি করেছেন। এর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে, এমনটি ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে, কে, কখন তা করেছে, সেটা এখনো জানা যায়নি। জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কেউ করিয়েছে কি না, তাও সন্দেহ করা হচ্ছে। অন্য কারও সঙ্গে বিরোধ ছিল কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ফারুক বলেন, ‘মনির হোসেনের স্ত্রী ও সন্তানের জন্য মগবাজারের একটি হোটেল থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলেন তাদের কেয়ারটেকার রফিকুল ইসলাম। আর মনির ও রফিক নিজেরা গিয়ে একই হোটেলে খেয়েছেন। এই হোটেলের খাবারে কোনো সমস্যা ছিল কি না, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। হোটেলটিতে আরও অনেক মানুষ সেদিন খেয়েছে, কেউ কোনো ধরনের অভিযোগ করেনি।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সম্পদের লোভে কেয়ারটেকার খাবারে কিছু মিশিয়েছে কি না, সেটা আমরা তদন্ত করছি। তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনা হয়েছে। এ ছাড়া ফরেনসিক রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা সম্ভাব্য সব বিষয় গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখছি।’
গ্রেপ্তার রফিকুল ইসলাম নিহত মনির হোসেনের চাচাতো চাচা। তিনি কেরানীগঞ্জে মনির হোসেনের দুটি বাড়ির দেখভাল করেন। গতকাল সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে তাকে আদালতে উপস্থাপন করেন রমনা থানার এসআই মো. জালাল উদ্দিন। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুব আলম তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন।
শুনানিতে বিচারক রফিকুল ইসলামের বক্তব্য শুনতে চান। তখন রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ যা বলছে, এর অতিরিক্ত আমি জানি না।’
তিনি আদালতে জানান, মনির হোসেন দুটি বাড়ি কেনেন কেরানীগঞ্জে। এর মধ্যে একটা ২০১২ সালে; আরেকটা ২০১৪ সালে। ২০১৬ সাল থেকে বাড়ি দুটি দেখাশোনা করছেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে তার মেয়ে ও মেয়ের স্বামী থাকে।
মনির হোসেনের স্ত্রী-সন্তানের জন্য কোথা থেকে খাবার নেন জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মগবাজারের ভর্তা-ভাত হোটেল থেকে। মনির বলে খাবার নিতে। এক বক্স ভাত, মুরগির রেজালা, আলু ভর্তা আর শুঁটকি ভর্তা নিই। মনিরের স্ত্রী শুঁটকি পছন্দ করে; এজন্য শুঁটকি নিতে বলে। ওরা খাওয়ার পর আমি আর মনির ওই হোটেলে নান, শিক কাবার আর ফালুদা খাই।’
রফিকুল আরও জানান, বাড়ির নাম পরিবর্তনের জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রয়োজন ছিল। এজন্য তাকে ১ লাখ টাকা দেন মনির। বাকি ৪০ হাজার ভাড়ার টাকা থেকে ম্যানেজ করে নিতে বলেন।
রফিকুল আদালতে দাবি করেন, জায়গা বা সম্পত্তি নিয়ে তাদের ভেতর কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
শুনানি শেষে তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন বিচারক। গতকাল রমনা থানায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রফিকুলকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। এর আগে গত রোববার মগবাজারের আবাসিক হোটেল ‘সুইট স্লিপ’ থেকে আদ-দ্বীন হাসপাতালে নেওয়া হলে সৌদিপ্রবাসী মনির হোসেন (৪৮), তার স্ত্রী নাসরিন আকতার স্বপ্না (৩৮) ও তাদের সন্তান আরাফাতকে (১৮) মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ভোলাকোট ইউনিয়নের দেহলা গ্রামে।
এ ঘটনায় দুদিন পর গতকাল রমনা থানায় মামলা করেন ওই প্রবাসীর ভাই নূরুল আমিন। তিনি মামলার এজহারে বলেন, কোরবানির ঈদে মনির হোসেন গ্রামে আসেন। প্রবাসে থাকা অবস্থায় মনির তাদের চাচাতো চাচা রফিকুল ইসলামের মাধ্যমে ঢাকাসহ গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় জমিজমা ও বাড়ি কেনেন। চাচা রফিকুলই সেসব দেখভাল করছিলেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, মনির দেশে আসার পর জমিজমা ও টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে রফিকুলের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। এর মধ্যে ২৮ জুন মনির ছেলের চিকিৎসার জন্য স্ত্রীসহ ঢাকায় আসেন। তারাসহ ঢাকায় অবস্থান করা চাচা রফিকুল ইসলাম নিউ ইস্কাটন রোডের এসপিআরসি হাসপাতালে যান। ওইদিন চিকিৎসকের সূচি না পেয়ে মনির স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মগবাজারের ‘সুইট স্লিপ’ হোটেলে ওঠেন। বিকালে পাশের ভর্তা-ভাত হোটেলে গিয়ে খাবার খান মনির ও রফিকুল ইসলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মনিরের স্ত্রী ও সন্তানের জন্য খাবার নিয়ে হোটেল কক্ষে যান রফিকুল। এরপর রফিকুল তার বাসায় চলে যান।
মামলায় বলা হয়েছে, চাচা রফিকুলের আনা খাবার মনির ও তার পরিবার খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে তারা বমি করতে থাকেন, তাদের আদ-দ্বীন হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এজাহারে মৃত মনিরের ভাই নুরুল আমিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনের কাছে শুনে আমার ধারণা হয় যে, আমার ভাইয়ের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য অজ্ঞাত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা পরিকল্পনা করে খাবারে বিষ মিশিয়ে অথবা অন্য উপায়ে তাদের হত্যা করেছে।’
মন্তব্য করুন