রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুর্নীতির বরপুত্র বলা হয় সামসুল আলম মিল্কিকে। ছোট চাকরি করেও ২২ বছর ধরে রাজউকে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। প্লট জালিয়াতি, নথি গায়েব ও এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) নকলসহ তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি অন্তত পাঁচশ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। নানা অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়েছিল। জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কয়েক দফা তলব করেছিল। বহু অভিযোগ ও বিভাগীয় মামলা মাথায় নিয়ে গত ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন। এমন অবস্থায় তার বিচার বা শাস্তি হওয়ার বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
কে এই সামসুল হক মিল্কি: মুন্সীগেঞ্জের মৃত পৈলন মিল্কির ছেলে সামসুল আলম মিল্কি। রাজউকের জরিপসাথী পদে চাকরি করতেন তার বাবা। বাবার হাত ধরেই দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী হিসেবে রাজউকে যোগ দেন সামসুল আলম মিল্কি। চাকরি নিয়মিত হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তিনি ঊর্ধ্বতন হিসাব সহকারী হয়ে যান। যোগ দেন রাজউক শ্রমিক-কর্মচারীদের নেতা আব্দুল জলিল, আব্দুল মালেক ও শফিউল্লাহ বাবু ওরফে সল্টুর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে হয়ে ওঠেন জালিয়াত চক্রের হোতা। ঢাকা শহরের ডিআইটি প্রজেক্ট, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে দুইশর বেশি প্লট হাতিয়ে নেওয়া বহুল আলোচিত গোল্ডেন মনিরের সঙ্গেও তার সখ্য গড়ে ওঠে। গোল্ডেন মনিরকে এসব প্লট পেতে সহায়তা করতেন মিল্কি। এরই মধ্যে ১৫ জন সিনিয়র কর্মচারীকে টপকে হিসাবরক্ষক হয়ে যান তিনি। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়ে বসতেন এস্টেট ও ভূমি-২-এর সহকারী পরিচালকের চেয়ারে। হয়েছেন অফিসার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকও। শেষ পর্যন্ত সহকারী পরিচালকের (চ. দা.) চেয়ারে বসেই পিআরএলে গেলেন রাজউকের এই মহাপ্রতাপশালী কর্মকর্তা।
মিল্কির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: রাজউকের নথি ঘেঁটে জানা গেছে, মো. মোস্তফা কামাল নামে এক ভুক্তভোগী রাজউকের চেয়ারম্যান বরাবর তার বায়না রেজিস্ট্রিকৃত প্লট আত্মসাতের অপচেষ্টার অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ মিল্কিকে বদলিসহ তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্তে জালিয়াতি প্রমাণিত হলে মিল্কির বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আগের জায়গায় ‘প্রাইজ পোস্টিং’ দেওয়া হয় মিল্কিকে।
২০১৬ সালে রাজউকের উত্তরা জোনাল অফিসের অফিস সহকারী মো. সাইদুল হক তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বরাবর মিল্কির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। সাইদুল হক তার অভিযোগে বলেন, ‘সামসুল আলম মিল্কি রাজউকের একজন অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। তিনি বিশাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রাজউকের উত্তরা, পূর্বাচল ও নিকুঞ্জের খালি প্লট বাছাই করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্লটের বরাদ্দপত্র, কিস্তি জমার ব্যাংক রসিদ হুবহু জাল করে নিজের আপন ভাই-বোন-ভাতিজা-স্ত্রী-সন্তানদের বরাদ্দ গ্রহীতা সাজিয়ে সুকৌশলে লিজ দলিল করে নিজেরাই মালিক বনে গেছেন। এই প্রক্রিয়ায় পূর্বাচল প্রকল্পে ৮টি ও উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ৫টি প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন। উত্তরায় ৭ নম্বর সেক্টরের ১৮ নম্বর সড়কের ৬৭ নম্বর প্লটটি ভুয়া বরাদ্দপত্র তৈরি করে ভায়রা ভাইয়ের নামে আত্মসাৎ করেছেন। ৯ নম্বর সেক্টরে সাড়ে সাত কাঠা প্লটের ওপর ৯তলা আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন।’
সাইদুল হকের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব (প্রশাসন-৬ শাখা) শ্যামল নবীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র তলব করে তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত আবেদন করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলী আকবর। এ ছাড়া মিল্কির বিরুদ্ধে জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্তের জন্য ২০১৬ সালের ১২ মে তাকে দুদকে তলব করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট তথ্য ও রেকর্ডপত্রসহ বক্তব্য গ্রহণের জন্য মিল্কিকে ডাকেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম সরকার।
রাজউক এস্টেট ও ভূমি-২-এর এক কর্মকর্তা জানান, ১২ বছর পর্যন্ত তাকে কেউ এসিআর দেয়নি। রাতারাতি এসিআর ম্যানেজ করে কর্মচারী থেকে কর্মকর্তা বনে যান এই মিল্কি। তার চাকরি শেষ হলেও রাজউকে আসা বন্ধ হয়নি। উল্টো দাপট যেন আরও বেড়ে গেছে।
মিল্কির যত সম্পত্তি: ২০০২ সালে রাজধানীর খিলক্ষেতে রাজউক ট্রেড সেন্টার নির্মাণ শুরু হলে তার কপাল খুলে যায়। কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদের প্রভাব খাটিয়ে অন্তত ২০টি দোকানের পজেশন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন মিল্কি। পূর্বাচল ও ঝিলমিল প্রকল্পে একাধিক প্লট, নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় ১/ডি এবং ১৩ নম্বর রোডে ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে তার। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে রয়েছে ৯ তলা বাড়ি। বর্তমানে প্লটসহ বাড়ির মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। সোনারগাঁ জনপথ রোডে ৪ কাঠার প্লটে রয়েছে বহুতল ভবন। বনানীতে রোড নং-২৮, ব্লক-কে, হাউস নং ১৭/এ, এর ৫ কাঠার একটি প্লট জালিয়াতির মাধ্যমে বরাদ্দ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। বারিধারা জে ব্লকে তিনটি বাড়ি রয়েছে। সব মিলিয়ে শুধু রাজধানীতেই তার পাঁচশ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। ব্যবহার করেন কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল গাড়ি। এ ছাড়া রাজউকের বিভিন্ন প্রকল্পে প্লটের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে বহু মানুষের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছেন। তাদের অধিকাংশকেই প্লট দিতে পারেননি। ফেরত দেননি টাকাও।
উত্তরা এলাকার মসজিদের এক সাবেক ইমাম বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে তার (মিল্কি) কাছে ৭ লাখ টাকা পাওনা রয়েছি। প্লট দেবে বলে টাকা নিয়েছিল। এখন ফোন দিলে আর ফোনও ধরে না। তার এত এত সম্পত্তি থাকার পরও সে মানুষের পাওনা টাকা পরিশোধ করছে না। শতাধিক লোক তার কাছে ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা পায়।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত তিন দিন সামসুল আলম মিল্কির উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়িতে যান এ প্রতিবেদক। কিন্তু তাকে বাসায় পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। এসএমএস পাঠালেও ফিরতি কোনো জবাব দেননি তিনি। ফেসবুক মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি।