তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা (আইটিইএস) খাতে করপোরেট কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী জুনে। অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো না হলে এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের আয়ের ওপর ২৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর দিতে হবে। বিষয়টি দেশের আইটি, আইসিটি এবং আইটিইএস খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে বলে উদ্যোক্তারা মনে করছেন। তাদের মতে, কর অব্যাহতি তু্লে দেওয়া হলে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক—উভয় বাজারেই অবস্থান হারাবে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত। সেইসঙ্গে উদ্যোক্তাদের বিদেশমুখী হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ও বিদেশে আইটি, আইসিটি এবং আইটিইএস খাতের ৩৪০ কোটি ডলারের বাজার রয়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি বাজার ১৮০ কোটি ডলারের। এ খাতে প্রায় ৩ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি এবং ২০৩১ সাল নাগাদ আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এই খাতে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত আইসিটি খাতে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তাতে কর অব্যাহতির সহায়ক ভূমিকা ছিল। ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও এই অব্যাহতি বহাল থাকা দরকার। তা না হলে দেশীয় আইটি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে করপোরেট কর অব্যাহতি পাচ্ছে আইটি, আইটিইএস খাত। এ খাতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রতি বছর কর মওকুফ সনদ ইস্যু করে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে কর মওকুফের এই সুবিধা শেষ হচ্ছে চলতি অর্থবছরে। এই কর সুবিধা না থাকলে ছোট ও মাঝারি আকারের আইসিটি কোম্পানিগুলো ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি এই খাতে কর্মরত পেশাজীবীরাও হতে পারেন কর্মহীন।
আইসিটি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ‘কভিডের পর দেশের আইসিটি খাত যেখানে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, করপোরেট ট্যাক্স অব্যাহতি না থাকলে সেটা আবার বসে যাবে। প্রতিযোগিতার বাজারে সুবিধাজনক অবস্থান হারাবে প্রতিষ্ঠানগুলো।’
কর অব্যাহতি বহাল রেখেও আইসিটি খাত থেকে সরকারের আয়ের সুযোগ রয়েছে জানিয়ে ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বন্ডস্টাইন টেকনোলজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মীর শাহরুখ ইসলাম বলেন, ‘করপোরেট ট্যাক্স অব্যাহতি না থাকলে ২৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হবে। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রফিট মার্জিন ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর কস্ট অব গুডস এবং কস্ট অব সার্ভিস বেড়ে যাবে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। বাধ্য হয়ে না চাইতেও তখন অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করবে বা বেতন হ্রাস করবে। তখন কিন্তু আয়কর বাবদ রাজস্ব আয় কমবে রাজস্ব বোর্ডের। অথচ প্রতি বছর এই খাতে নতুন করে ২০ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। এই খাতের প্রবৃদ্ধি হলে কর্মী সংখ্যা বাড়বে, তাদের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। কর্মীরা তখন আয়কর দেবে, কেনাকাটায় ভ্যাটসহ অন্যান্য কর দেবে। ফলে পরোক্ষভাবে রাজস্ব বোর্ডের যে আয় হবে, সেটা করপোরেট ট্যাক্স অব্যাহতিকে পুষিয়ে দেবে।’
আইসিটি খাতকেন্দ্রিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পর ধাপে ধাপে করপোরেট কর আরোপের পক্ষে মত দিয়েছেন আলমাস কবীর। হুট করে রেয়াত শতভাগ উঠিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত আইসিটি খাতের বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে আলমাস কবীর বলেন, ‘আইসিটি খাত কি কখনোই এই কর দেবে না? অবশ্যই দেবে, তবে সেটা ধাপে ধাপে হওয়া উচিত। ২০২৫ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। পাশাপাশি এই সুবিধা বছরভিত্তিক না দিয়ে, একবারে লম্বা সময়ের জন্য দেওয়া হোক। এতে উদ্যোক্তারা এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী পাবেন, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তাদের কাছে দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা থাকবে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে ধাপে ধাপে অব্যাহতি উঠিয়ে নেওয়া যেতে পারে।’
পণ্য বা সেবার মূল্য বেড়ে গেলে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের বদলে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের বাজারমুখী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানও অফশোর কোম্পানি খুলতে পারে বিদেশে। মীর শাহরুখ ইসলাম বলেন, ‘আফ্রিকার প্রযুক্তি বাজার বড় হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি সেবা বা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়, আর অন্য কোনো দেশ যদি একই জিনিস কম মূল্যে অফার করে, তাহলে বিদেশি ক্রেতারা সেদিকে ঝুঁকতে পারে। অন্যদিকে করের অতিরিক্ত বোঝা হলে অনেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিদেশে অফশোর কোম্পানি খুলতে পারে। তখন কিন্তু চাপ পড়বে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। এ ছাড়া ২০০৫ সালের তুলনায় ২০২৪ সাল প্রযুক্তি খাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এআই, আইওটি, ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার দেখতে পারছি। দেশীয় উদ্যোক্তারা যদি এই ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে।’