শাহনেওয়াজ খান সুমন
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৩, ০২:১৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডেঙ্গুর চিকিৎসা

ঢামেকে মেঝেতেও ঠাঁই নেই, চলছে সিট বাণিজ্য

সিট না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতেও অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। ছবি: কালবেলা
সিট না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতেও অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। ছবি: কালবেলা

পুরান ঢাকার আগা সাদেক রোডের বাসিন্দা আঞ্জুয়ারা। ২৮ বছর বয়সী এই তরুণী চাকরি করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার কাজ রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন নিজেই ভর্তি রয়েছেন কর্মস্থলে। গত ৯ জুলাই হঠাৎ তার শরীরে ব্যথা ও হালকা জ্বর শুরু হয়। সময় গড়াতে তার শরীরের ব্যথা ও জ্বরের তীব্রতা বাড়তে থাকে। পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু পজেটিভ ও প্লাটিলেট মাত্র ১৯ হাজার দেখা যায়। ১৩ জুলাই ভর্তি হন হাসপাতালে। ভাগ্যগুণে তিনি সিট পেলেও এই হাসপাতালে ভর্তি অর্ধেকের বেশি রোগীর চিকিৎসা চলছে মেঝেতে। সেখানেও আর ঠাঁই মিলছে না রোগীদের। মেডিসিনের প্রতিটি ওয়ার্ড ও এর বাইরে অতিরিক্ত রোগী এবং স্বজনের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসদের ধর্মঘটের কারণে সেই চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। এদিকে চিকিৎসা নিতে এসে নানা রকম হয়রানি আর ভোগান্তিতে পড়ছেন অনেকে। সিট বাণিজ্যও থেমে নেই। সবমিলিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত অসহায় মানুষের কষ্টের যেন শেষ নেই।

আঞ্জুয়ারা জানালেন, ঢাকা শহরে মশা নিয়ন্ত্রণে যাদের দায়িত্ব সেই সিটি কপোরেশন সঠিকভাবে কাজ করে না। যার শিকার হচ্ছি আমরা। মশা মারতে তাদের কামান দেখি না। ওষুধ স্প্রে ও ড্রেন পরিষ্কার না করায় মশা বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেলেও ঠিকমতো মশার ওষুধ স্প্রে করা হয় না।

হাসপাতালটির নতুন ভবনের ৬০১, ৬০২, ৭০১, ৭০২, ৮০১ ও ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ রোগীরাও চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বিছানার পাশাপাশি তাদের রাখা হয়েছে ফ্লোরসহ লিফটের আশপাশে। একদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রোগী আর অন্যদিকে বিভিন্ন জেলার রোগীদের চাপে ঢামেকের মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে পা ফেলার জায়গাটুকুও নেই। মেডিসিনের পুরুষ-নারীদের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডের সব শয্যা রোগীতে পূর্ণ। প্রতিটি ফ্লোরের ওয়ার্ডের বাইরের সিঁড়ির পাশের ফাঁকা স্থানের মেঝেতে শত শত রোগী। প্রতি রোগীর সঙ্গে দু-তিনজন স্বজন আছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালটি সাধারণ রোগীদের শেষ ভরসাস্থল। সারা দেশ থেকেই চিকিৎসা নিতে এখানে রোগীরা আসেন। বছরের সবসময় মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে রোগীর চাপ বেশি থাকে। মেডিসিনের রোগী বেশি হওয়াতে এই বিভাগের জন্য অনেকগুলো ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়াতে ডেঙ্গু রোগী ও মেডিসিনের অন্য রোগীদের চাপ পড়েছে এসব ওয়ার্ডে। কিছুদিন আগেও ঢাকার ভেতরের রোগীরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বেশি ভর্তি হতো। কিন্তু কিছুদিন থেকে ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে অহরহ রোগী আসছেন। এতে করে মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। একজন রোগী ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি গেলে একটি শয্যা ফাঁকা হয়। আর ওই শয্যা পাওয়ার আশায় ৫০ রোগী অপেক্ষায় থাকেন।

গতকাল সরেজমিন ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৫৫ ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ১৮ জন বেড পেয়েছেন। সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে সামনে হাঁটা-চলার জন্য ফাঁকা জায়গাও গাদাগাদি করে চলছে চিকিৎসা। কারও হাতে স্যালাইন দেওয়া, কেউ ওষুধ খাচ্ছেন, আবার কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। গরমে ঘুমাতেও পারছেন না রোগীরা। স্বজনরা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। এদিকে কেউবা ক্লান্ত হয়ে জায়গা না পেয়ে সিঁড়িতে শুয়ে পড়ছেন।

চানখারপুলের বাসিন্দা বেলায়েত হোসেনের চিকিৎসা চলছে বৃহস্পতিবার থেকে। জ্বর, প্রেসার ছাড়াও নাক ও দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে তার। প্লাটিলেট ২৮ হাজারে নেমে আসায় উদ্বিগ্ন পরিবার। হাসপাতালের মেঝেতে আজিমপুরের বাসিন্দা শাহিদা হকের সময় কাটছে দুশ্চিন্তায়। নবম শ্রেণির ছাত্রী একমাত্র মেয়ে আয়শা হককে নিয়ে তিনি হাসপাতালে আছেন চার দিন।

৬০১ নম্বর ওয়ার্ডের এক সিটে মশারি টানিয়ে শুয়ে আছেন গফুর মিয়া। তার পাশে থাকা ছেলে আনিসুর রহমান বলেন, ছয় দিন ফ্লোরে থাকার পর অনেক কষ্টে সিট ম্যানেজ করেছি। এক আনসার সদস্য কিছু অর্থের বিনিময়ে সিটটি দিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে স্যালাইন ও কিছু ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকে আনতে হচ্ছে।

৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে সিঁড়ির পাশে চিকিৎসা নিচ্ছেন মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা মো. মামুন। তিনি বলেন, অন্য রোগ হলেও আমাকে ডেঙ্গু রোগীদের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। এতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ভালো হচ্ছে, না আমাদের। অথচ আলাদা আলাদা ইউনিট করলে সবার জন্য ভালো হতো।

স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি শুধু দেয়ালে লেখাতেই সীমাবদ্ধ। রোগীরা ঝুড়িতে ময়লা রাখলেও অনেক সময় দায়িত্বরতরা তা নেন না। এখানে মশা-মাছি ভোঁ ভোঁ করে। ৬০১ ইউনিটের ৯ নম্বর রুমের পাশে ওয়াশরুমের সামনে ময়লার ঝুড়িগুলো পরিষ্কার না করায় গন্ধ বের হচ্ছে, আর মশা-মাছিও উড়ছে। ওয়াশরুমে যারা আসছেন তাদের কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ওয়াশরুমে যেতে দেখা যায়।

কেরানীগঞ্জ থেকে আসা আরিফুল ইসলাম বলেন, ছয় দিন হয়ে গেলেও এখনো বাবার জন্য একটি সিট ম্যানেজ করতে পারিনি। আমি ও আমার মা এখানে কীভাবে আছি, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমরা নিজেরা অসুস্থ হয়ে যাই কি না, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। আমাদের পরে এসে অনেকে দেখছি আনসারদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে যেন সিট ম্যানেজ করে ফেলছেন। আর আমাদের শুধু আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে—অপেক্ষা করেন, সিট পাবেন, চাপ বেশিসহ আরও নানা কথা। তবে এখন আমি এটা বুঝতে পারছি টাকা দিতে পারলে আমরাও সিট পেতাম।

হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয়প্রধান ডা. আজিজ আহমেদ খান বলেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি। যারাই আক্রান্ত হচ্ছেন তারা সহজেই ভালো হচ্ছেন না। সাময়িকভাবে ভালো হয়ে হাসপাতাল ছাড়লেও ভুগতে হচ্ছে অনেকদিন। অতীতে কোনো বছরই ডেঙ্গু পরীক্ষার এত চাপ পড়েনি। কিন্তু এ বছর আমরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি। গত কয়েকদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ শিক্ষার্থীর ডেঙ্গু পরীক্ষা এখানে করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে যেসব রোগী আসছেন তাদেরও ডেঙ্গুজনিত পরীক্ষার চাপ বেড়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। তবে চিকিৎসা দিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। শুধু ডেঙ্গু নয়, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জটিল ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনে নেই তবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যারা ভর্তি হতে চাচ্ছেন, তাদের ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। সিট বাণিজ্যসহ রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে টাকা দিয়ে সিট নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। স্পষ্ট করে বলতে চাই যারা টাকা দিয়ে সিট নেয় তাদের বলবেন তারা যেন জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্তার বিরুদ্ধে আমাদের কাছে এসে অভিযোগ দেয়। তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গরম পানি পান করলে কি সত্যিই ওজন কমে?

অবশেষে বিচ্ছেদ নিয়ে মুখ খুললেন সোহেল খান

যৌবন ধরে রাখতে সার্জারি করেছেন রোনালদো, দাবি সার্জনের

জাতিসংঘের বিশেষ দূতের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

ওয়ানডেতেও অধিনায়ক হচ্ছেন গিল!

যুক্তরাষ্ট্রে ‘বেস্ট হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মিলন

ড্রাগন ফল কারা খেতে পারবেন না জানালেন পুষ্টিবিদ

সুনামগঞ্জে ভুয়া এনএসআই সদস্য গ্রেপ্তার

সাবেক জিএস গোলাম রাব্বানীর পদ-ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি রাশেদের

ব্যক্তিগত মিলে মজুত করা ছিল সরকারি চাল

১০

অনূর্ধ্ব-১৭ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ / ভারতের বিপক্ষে বিকেলে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

১১

সড়কে খানাখন্দ, দুর্ভোগ লাখো মানুষের

১২

নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি মানসী

১৩

কলকাতায় টানা ৩ দিন দুর্যোগের সতর্কতা

১৪

২০২৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপ : কোন দেশে কত ম্যাচ জানিয়ে দিল আইসিসি

১৫

সপ্তাহের সেরা সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি, পদ প্রায় ১৬০০

১৬

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১৭

জুমার খুতবার সময় কি মোবাইল ব্যবহার করা যাবে?

১৮

দুপুরের মধ্যে ৭ জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১৯

ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দিচ্ছে ফিফা, যেভাবে করবেন আবেদন

২০
X