দুদিনব্যাপী সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর অভিযান শেষ করে ১৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এসে পৌঁছলাম। দুপুরের আহার সেরে বিকেলটা বনের ভেতরের ছোট পুকুরের পাড়ে পাখি-প্রাণীর ছবি তুলে কাটালাম। পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই মান্দারগাছের পাশের টাওয়ারে গিয়ে উঠলাম ভোরের ক্ষুধার্ত পাখিগুলোর ছবি তোলার জন্য। মান্দার ফুলের রস পানের জন্য প্রথমেই এলো ফিঙে পণ্ডিত বা কেশরাজ (Hair-crested Drongo)। আমি বহুবার এই পাখিটিকেই সর্বপ্রথম মান্দারের রস পান করতে দেখেছি। এরপর একে একে এলো সোনাকপালী হরবোলা (Golde-fronted Leafbird), কাঠ শালিক (Chestnut Starling), ভাত শালিক (Common myna) ও কইরিদি টিয়ে (Blossom-headed Parakeet)।
টাওয়ারে ওঠার ঠিক এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের মাথায় মান্দারের ছোট্ট একটি ডালে এসে বসল হলুদ ঠোঁট ও লতিকার কালো একটি পাখি। এর আগে যতবার সাতছড়ি এসেছি, কালো পাখিটিকে টাওয়ারের চারদিকের প্রায় সব গাছে বসতে দেখলেও মান্দারের ডালে বসতে দেখিনি। কাজেই ওকে মান্দারের ডালে দেখে দ্রুত ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করতে থাকলাম। কিন্তু কতক্ষণ? মাত্র ১৮ সেকেন্ড; এ সময়ের মধ্যে মোট ১০টি ক্লিক করতে পারলাম। এরপর সে উড়াল দিল। আশা করেছিলাম মান্দারের টকটকে লাল ফুলের ওপর বা ফুলের পাশে কিংবা ফুলের রস পানরত অবস্থায় তার ছবি তুলব। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। সে মান্দারের যে ডালে বসেছিল, সেখানে অল্প কটি কলি ছিল, কোনো ফুল ছিল না। কিছুক্ষণ পর মান্দারের গাছে একই প্রজাতির তিনটি পাখি এলো। মনে আবার আশা জাগল। চুপচাপ সেগুলোর ছবি তুলতে লাগলাম। কিন্তু এর পরও তারা ফুলের ওপর বা পাশে বসল না এবং দ্রুত মান্দার গাছ থেকে উড়ে পালাল।
এতক্ষণ হলুদ ঠোঁট-লতিকা ও কালো দেহের যে পাখিটির কথা বললাম, সে আর কেউ নয়, আমাদের অতি পরিচিত কথা বলা ময়না (Common Hill myna, Hill myna or Grackle)। এটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। স্টুরনিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Gracula religiosa (গ্র্যাকুলা রেলিজিওসা)। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাসিন্দাটিকে মূলত এ দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে দেখা যায়।
ময়নার দেহের দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৯ সেন্টিমিটার ও ওজন ২১০ গ্রাম। একনজরে চকচকে কালো পাখি। সঙ্গে বেগুনি ও সবুজের আভা মেশানো। ডানায় রয়েছে সাদা রঙের পট্টি। কালো মাথার পেছন দিকে ঝুলন্ত হলুদ লতিকা। ঠোঁট কমলা-হলুদ, ঠোঁটের আগা হলুদ। চোখ কালচে-বাদামি। পা সোনালি-হলুদ। পায়ের আঙুল হলুদ হলেও নখ কালো। স্ত্রী-পুরুষের পালকের রঙে কোন পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পালকের রং বড়গুলোর তুলনায় ফ্যাকাশে। কানের লতি হলদেটে-সাদা ও ঝুলন্ত নয়। ঠোঁট ফিকে হলদেটে-কমলা।
মিশ্র চিরবুজ বলের আবাসিক পাখিটি মূলত সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি বন ও চা বাগানের প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করে। শাখাচারি ও দিবাচর পাখিটি একাকী, জোড়ায় কিংবা ছোট দলে বিচরণ করে। সচরাচর ন্যাড়া গাছের উঁচু ডালে বসতে পছন্দ করে। সচরাচর গাছে গাছেই খাবার খোঁজে, মাটিতে নামতে দেখা যায় না। রসালো ও পাকা ফল, কুঁড়ি, ফুলের রেণু ও নির্যাস এবং পোকামাকড় মূল খাবার। গলার স্বর পরিবর্তনশীল, সচরাচর উচ্চ স্বরে ‘টি-অং-টি-অং…’ শব্দে ডাকাডাকি করে। অন্য পাখিদের স্বর নকলে ওস্তাদ। চমৎকার শিস দেয়।
মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় বন বা চা-বাগানের ধারে উঁচু গাছের কোটরে বা কাঠঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায় ঘাস, পালক ও আবর্জনা দিয়ে বাসা বানিয়ে দুই থেকে তিনটি নীল রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৫ থেকে ১৯ দিনে। আয়ুষ্কাল ১২ থেকে ১৫ বছর।
দুর্লভ এই পাখিটির কথা অনুকরণ করতে পারার ক্ষমতাটিই বুনো পরিবেশে তাদের বেঁচে থাকার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিকারিরা বন থেকে নিয়মিত ময়না ধরে পাখি বিক্রেতাদের কাছে চালান দিচ্ছে। পোষা পাখি হিসেবে এ দেশে ময়নাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। কিছুদিন আগ পর্যন্ত ঢাকার কাটাবনের পোষা পাখির মার্কেটে বিক্রি হতো। আশার কথা কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সংগঠনগুলোর কারণে কাটাবনে এখন আর ময়না-টিয়া বিক্রি চোখে পড়ে না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মিরপুর-১ ও টঙ্গি বাজারসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় এখনো ময়নাসহ দেশি পাখির কেনাবেচা চলছে। যদিও ময়না এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা পাখি; কিন্তু দেশের বন্যপ্রাণী আইনে ময়নাসহ সব বুনোপাখি পোষা নিষিদ্ধ। কাজেই সবার কাছে নিবেদন পাখি পুষতে হলে বিদেশি কেইজ বার্ড পালন করুন, বন থেকে দেশি পাখি ধরে এনে নয়। আমাদের বনের পাখি বেঁচে থাকুক প্রকৃতিতে। আমরা ময়নাসহ অন্য পাখিদের মুক্তভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করব।
লেখক: পাখি, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর