ছয় বছর মেয়াদে রেলের ৭০টি ইঞ্জিন সংগ্রহ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালে। পরের বছর ২০১১ সালের আগস্টে তা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পায়। এজন্য অর্থ বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। কথা ছিল, প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুনে শেষ হবে। অথচ দীর্ঘ সময়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে শেষে তিন দফা টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিলেও প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
রেলওয়ের ৭০টি মিটারগেজ (এমজি) ডিজেল ইলেকট্রিক (ডিই) লোকোমোটিভ সংগ্রহ (প্রথম) সংশোধিত এই প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে ঋণের উচ্চ সুদের বিষয়টি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ২০১০ সালের প্রকল্পের ত্রুটি ধরা পড়ে ২০২২ সালে। এরপর শুরু হয় চিঠি চালাচালি। মূলত উচ্চ সুদের কারণে প্রায় ১৪ বছর পর প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করা হয়েছে। এজন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানোর পর এ বিষয়ে গত মে মাসের মাঝামাঝি বৈঠক শেষে বিষয়টি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে গেছে।
গত ২৮ মে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (এসপিইসি) সভার কার্যবিবরণীতে বর্ণিত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করার প্রস্তাব আরডিপি ছকে পূরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রেল সচিব বরাবর চিঠি পাঠানো হয়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাচাই-বাছাই না করে প্রকল্প হাতে না নেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অথচ রেলের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভিত্তিক এই প্রকল্পটি সবার আগে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। তা না হওয়ায় পুরো রেলসেবা এখন ব্যাহত হচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৮ জুন প্রকল্পের পরিচালক মো. বোরহান উদ্দিন প্রকল্পটি সমাপ্ত করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে আরডিপিপি ছক পাঠাতে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা বরাবর আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির ডিপিপি হয় ২০১১ সালের ২৩ আগস্ট। এ অনুযায়ী প্রকল্পের অধীনে ৭০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ সংগ্রহে ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রথমবার এবং পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু তখন গ্রহণযোগ্য দরদাতা পাওয়া যায়নি। এরপর ২০১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তৃতীয়বার এই প্রকল্পে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তৃতীরবারের দরপত্র প্রক্রিয়ায় ক্রয় প্রস্তাব ২০১৮ সালের ১ মে সিসিজিপির অনুমোদন হওয়ার পর একই বছরের ১০ অক্টোবর হুন্দাই রোটেম কোম্পানির সঙ্গে রেলওয়ে শর্তসাপেক্ষে বাণিজ্যিক চুক্তি করে। পরবর্তী সময়ে ঋণের খসড়া প্রণয়নে তিনটি পৃথক চুক্তিপত্র হয়। চুক্তির খসড়ার ওপর বিভিন্ন দপ্তরের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ইআরডি থেকে একটি চিঠি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এরপর আহ্বানকৃত তৃতীয়বারের দরপত্র প্রক্রিয়া ও বাণিজ্যিক ক্রয়চুক্তি বাতিল এবং দরদাতার দাখিলকৃত পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি পিআইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে সিপিটিইউ, আইএমইডি এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পত্রের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট দরপত্র ও বাণিজ্যিক আদেশ করে দরদাতার দাখিলকৃত ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি প্রতিনিধি পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি গ্রহণ করে। এ অবস্থায় প্রকল্পের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণে একই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) সভার সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ এ বিষয়ে মতামত দেয়। সে অনুযায়ী প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করার পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এরপর প্রকল্প বাতিলে রেল মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি যায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ মার্চ পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সচিব ড. মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সভাপতিত্বে প্রকল্প সমাপ্ত করতে বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত মে মাসের মাঝামাঝিতে প্রকল্প বাতিলে সংশ্লিষ্ট সবার স্বাক্ষর শেষে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠানো হয়।
প্রকল্পের ডিপিপিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমানে ২৭৫টি লোকোমোটিভ রয়েছে। যার মধ্যে ১৮১টি মিটারগেজ ও ৯৪টি ব্রডগেজ। লোকোমোটিভের বা ইঞ্জিনের ইকোনমি লাইফ হলো ২০ বছর। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৪২টি ইঞ্জিনের এই লাইফ এরই মধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। পুরোনো লোকোমোটিভের রক্ষণাবেক্ষণ যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি নির্ভরযোগ্যতা খুবই কম।
প্রকল্পের কার্যক্রমে বলা হয়েছে, ৭০টি ইঞ্জিন কেনা ছাড়াও এই প্রকল্পের মাধ্যমে পার্বতীপুরে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপের সুবিধাগুলোর উন্নয়ন করা হবে। লোকোমোটিভ অ্যাসেমব্লিং করার সক্ষমতা তৈরির জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রকল্পে ৩০টি সম্পূর্ণ লোকোমোটিভ, ২৫টি সেমি নক-ডাউন কন্ডিশন লোকোমোটিভ এবং ১৫টি সম্পূর্ণ নক-ডাউন কন্ডিশন লোকোমোটিভ সংগ্রহ করা। শুরুর সাত বছর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল শূন্য দশমিক ৫০ ভাগ।
রেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি কেন বাতিল হলো এ নিয়ে আছে বিস্তার আলোচনা। এক্ষেত্রে সব দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ প্রকল্প গ্রহণের অনেক পরে ঘুম ভাঙে রেলের কর্মকর্তাদের। তা-ও পরিকল্পনার কমিশনের পরামর্শ পাওয়ার পর। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মূলত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লোন চূড়ান্ত করতে বছরের পর বছর সময় নিয়েছে। এরপর লোনের সুদ চড়া হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করতে হয়েছে।
এদিকে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বেশি দরে লোকোমোটিভ না কিনে সরকারি অর্থায়নেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সমীচীন হবে। এখানে উচ্চ মূল্যে দরদাতার অর্থায়ন গ্রহণ না করাই ভালো বলেও রেলকে দেওয়া এক চিঠিতে এমন পরামর্শ আসে। বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) বৈঠকে সদস্যরা এই মতামত তুলে ধরেন। মূলত এর পরই টনক নড়ে রেল কর্তৃপক্ষের।
জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, মূলত বেশি সুদের কারণে প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। তার মানে এই নয়, রেলওয়ে লোকোমোটিভ কিনেবে না। আমরা আপাতত কিছুটা ইঞ্জিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ২০৩০ সালের মধ্যে রেলের ইঞ্জিন সংকট সমাধান হয়ে যাবে।
সঠিক পরিকল্পনা ও যাচাই-বাছাইয়ের অভাবে রেলের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প বছরের পর বছর ঝুলে ছিল বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, লোনের বিষয়ে আগেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলা গেলে বা কোরিয়ান ব্যাংকের সুদের হারের বিষয়টি জানা থাকলে প্রকল্পটির এমন পরিণতি হতো না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, লোকোমোটিভের সংকটে একের পর এক ট্রেন চলাচল বন্ধ হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে তা চরম আকার ধারণ করতে পারে।