মিরপুর-১০ নম্বর ফুট ওভারব্রিজের পাশেই মেট্রোরেলের স্টেশন। গত দুটি বছর এখানে দিনভর ছিল অগণিত মানুষের আনাগোনা। স্টেশনগামী সিঁড়িজুড়ে ছিল ওঠানামার ব্যস্ততা। সেখানেই এখন সুনসান নীরবতা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে রাজধানীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মতো মেট্রোরেলের এই স্টেশনটিতেও উন্মত্ত হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাঁচ দিন পার হলেও স্টেশনজুড়ে রয়ে গেছে ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন মিরপুর-১০ নম্বরে দেখা গেছে, আগুনে ঝলসে যাওয়া ওভারব্রিজটির নিচে দায়িত্ব পালন করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পাশেই মেট্রোরেলের প্রবেশপথে পুরো শূন্যতা। সিঁড়িতে নেই সবার আগে ওঠা কিংবা নামার প্রতিযোগিতা। রাস্তার দুপাশের প্রবেশপথের ফটক বন্ধ।
এর মধ্যে ‘বি’ ফটকটি এখনো ভাঙা। একপাশে তালা ঝুলছে। আর ভাঙা অংশটি কালো সুতো দিয়ে বাঁধা। সিঁড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা।
‘সি’ ফটক পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে স্টেশনের ভেতরে প্রবেশ করতেই ডান পাশে চোখে পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাচ ভাঙা আর ইটের টুকরা। কদিন আগেও স্টেশনের কাচের দেয়ালগুলোতে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। সেগুলো এখন অনেকটাই ম্লান। ঠিক তখনো বোঝা যাচ্ছিল না, ভেতরের পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে। হাজারো ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিরপুর-১০-এর আধুনিক এই মেট্রো স্টেশনটি।
স্টেশনের ভেতরে ঢুকতেই চোখ রীতিমতো কপালে ওঠার জোগাড়। স্টেশনজুড়ে ধ্বংসের ক্ষতচিহ্ন।
বিধ্বস্ত স্টেশনটি পাহারা দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য। ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখে আফসোস করছিলেন তারা।
তাদের সামনে কাচঘেরা এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম নির্দেশক অংশে লেখা রয়েছে, ‘কমলাপুর অভিমুখে’, দুই নম্বর অংশে রয়েছে ‘উত্তরা উত্তর অভিমুখে’। এই রুমের সব কাচ ভাঙচুর করা হয়েছে। মেঝেতে পড়ে আছে ভাঙা কম্পিউটারের অংশবিশেষ। কাচের স্তূপ, ময়লা রাখার ঝুড়ি, ইটসহ স্টিলের বারগুলো
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। উল্টে আছে টেবিল, চেয়ারসহ সব আসবাবপত্র। স্টিলের বারগুলো দেখে বোঝার উপার নেই, এগুলো দিয়ে সাজানো-গোছানো ছিল পুরো স্টেশনটি।
এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই মেট্রো স্টেশনটিতে প্রবেশ করে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। তারা প্রায় ১৫ মিনিট স্টেশনে দ্বিতীয় তলায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পরিদর্শন করেন।
মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশনে দায়িত্ব পালন করা লোকজন জানিয়েছেন, স্টেশনের চারটি গেটের মধ্যে ‘এ’ ও ‘ডি’ নম্বর গেট ভেঙে হামলাকারীরা দ্বিতীয় তলায় প্রবেশ করে। তবে তারা তৃতীয় তলার প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে পারেনি। দ্বিতীয় তলাজুড়ে লাঠিসোটা, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী তাণ্ডব চালায়।
তারা জানান, প্রথমে নিরাপত্তা কর্মীরা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ব্যাপক মানুষ গেটের সামনে আগুন দিয়ে তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করায় অনেকেই প্রাণভয়ে নিরাপদ স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেন। বর্তমানে স্টেশনে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ সংযোগ সচল হয়েছে।
দায়িত্বরতরা জানান, কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে কার্যত কিছুই আর অক্ষত নেই। এ দুই স্টেশনে ফটক ভেঙে দুষ্কৃতকারীরা লাঠিসোটা নিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করে। প্রথমেই তারা সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট করে।
স্টেশনে দায়িত্বরত কারও মুখে হাসি নেই। হামলা চলার সময় যারা স্টেশনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কারও মন থেকেই সেই নৃশংসতার দৃশ্য সরছে না। সবকিছু যেন এখনো জীবন্ত হয়ে চোখে ভাসছে। তাদের চোখেমুখে অজানা আতঙ্ক। ভয়। কেউ কোনোদিন কল্পনাও করেনি, গুরুত্বপূর্ণ এ স্থাপনাটি দুর্বৃত্তদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। সবাইকে পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। কিছুক্ষণ পরপর খবর আসছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসছেন।
স্টেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ কন্ট্রোল রুম। সেখানে প্রবেশ করতেই দেখা গেল, ট্রেনে ভ্রমণের সিঙ্গেল জার্নির হাজারো কার্ড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুরোপুরি ক্ষতবিক্ষত এই ওয়ার্ক স্টেশন।
উল্টে আছে টেবিল, চেয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি। এই কক্ষের প্রথম যন্ত্রটি হলো বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এই মেশিনের সাহায্যে এসি, লাইন, চলন্ত সিঁড়িসহ ইলেকট্রিক সব স্টেশন কন্ট্রোল মনিটর করা হয়। এটি ভেঙে যাওয়ায় এসব কার্যক্রম অচল হয়ে গেছে।
পাশেই রয়েছে ভাঙচুরে বিকল হয়ে যাওয়া ‘এমসিপি’ মেশিন। এর সাহায্যে প্ল্যাটফর্মের দরজা খোলা বা বন্ধ করা হয়। স্টেশনের রেভিনিউ কন্ট্রোল ও ডাটা স্টক করা হতো ‘স্কোয়াট’ মেশিনের সাহায্যে। এই মেশিনটিও অক্ষত নেই। ট্রেন
আসা-যাওয়া মনিটর করাসহ ভয়েস দেওয়া হতো পিডস মেশিনের সাহায্যে। হামলায় এই মেশিনটিও এখন অকেজো। স্টেশন গেট, টিকিট কাউন্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ রুমগুলো ফোকাসে রাখতে কাজ করে সিসিটিভি ওয়ার্ক স্টেশন যন্ত্র। এই তথ্য কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমেও জমা হতো নিয়মিত। এই যন্ত্রটিও ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে।
ট্রেন যে ট্র্যাকে চলাচল করে এবং কোন লোকেশনে আছে, এমনকি অন্য স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের চিত্র, আবহাওয়াসহ সরঞ্জামাদির অবস্থা দেখা যেত ‘স্কাডা’ যন্ত্রের মাধ্যমে। এই যন্ত্রটিও হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে।
পাস ছাড়া কোনো ব্যক্তি স্টেশনের ভেতরে যে কোনো রুমে প্রবেশের চেষ্টা করলে সংকতে দেয় এসসিএস মেশিন। মূলত স্টেশনের সিকিউরিটি ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করা গুরুত্বপূর্ণ এই মেশিনটি হামলায় বিকল হয়ে পড়ে আছে। স্টেশনের লে-আউট দেওয়া বা কোনো লোকেশনে আগুন লাগলে লাইট জ্বলে ওঠে ‘এমআইএমএলসি প্যানেলে’। সেই প্যানেলটিও নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কার্ড জমার পর স্টোর করে রাখার যন্ত্রটির নাম ‘পিজি গেট’। কন্ট্রোল রুমে পিজি গেট দুটি পড়ে থাকতে দেখা যায়। টিকিট কাউন্টারের পাশে থাকা ‘টিএফটি’ মনিটরটি ভাঙা রয়েছে। মূলত এই মনিটরে ট্রেন কখন আসে-যায়, তা দেখানো হতো।
স্টেশনে থাকা একাধিক ‘ফারায় হাইডেন কেবিনেট’, সিকিউরিটি কক্ষ কোনোকিছু অক্ষত নেই। স্টেশন মাস্টারের রুমে থাকা সবকিছু লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। প্রায় সবকটি সিসি ক্যামেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ক্যামেরা খুলে নিয়ে গেছে হামলাকারীরা। উভয় প্রান্তে ভেঙে ফেলা হয়েছে পিজি প্যাসেঞ্জার গেট। মূলত এই গেটে কার্ড পাঞ্চ করে যাত্রীরা স্টেশনে প্রবেশ বা বের হন। এ ছাড়া ক্ষতবিক্ষত উভয় পাশের সাইডের কাচ।
টিকিট ঘরে কোনো কিছু অক্ষত নেই। কাচ ভেঙে নিচে পড়ে আছে।
স্টেশনের অফিসকক্ষে প্রবেশ করে আলমারি ভেঙে লুটপাট চালানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ নথি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। একটু সামনে গেলেই দেখা গেছে, স্টেশনের উভয় পাশে থাকা সরাসরি টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহের জন্য রাখা ছয়টি ভেন্ডিং মেশিন ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি মেশিনের মনিটরের কাচ ফাটা দেখা গেছে। মেশিনগুলো আর কাজ করছে না। তেমনি ছয়টি সাধারণ টিকিট কাউন্টারও হামলায় ক্ষতবিক্ষত। এই কাউন্টারগুলো থেকে কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র হামলাকারীরা খুলে নিয়ে গেছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে বেশিরভাগ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র এসি। কয়েকটি এসি হামলাকারীরা নিয়ে গেছে। ডিজিটাল ঘড়িটি দেয়ালে থাকলেও সেটি এখন আর সচল নয়। হামলায় নিষ্প্রাণ ঘড়িটি কোনো রকমে ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষটিও ক্ষতিগ্রস্ত।
‘সি’ গেটের লিফট ও মনিটরটিও আক্রান্ত। এমআরটি পুলিশ কন্ট্রোল রুমটিও অক্ষত নেই। স্বয়ংক্রিয় প্রবেশপথটিও ভেঙে চুরমার করা হয়েছে।
স্টেশনে ৬০৭ নম্বর রুমের সামনে দেখা গেছে ভাঙা কাচের স্তূপ। ভেতরে জিনিসপত্র এলোমেলো। স্টেশনের উভয় প্রান্তে বাড়তি ভাড়া আদায় কক্ষে একটি টেবিল ছাড়া কোনোকিছুই নেই। কম্পিউটার, টিকিট কার্ড, টেলিফোন সেট কোনোকিছুই রুমে দেখা যায়নি। এই রুমের সবকিছু খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।
৬০১ নম্বর রুমের স্টেশন অফিসে সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আলমারি থেকে নিয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কাজীপাড়া ও
মীরপুর-১০ মেট্রোরেলের এই দুই স্টেশনে হামলার ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়ে এরই মধ্যে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। এই কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। হামলার ঘটনায় মীরপুর ও কাফরুল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত শেষে হামলার ঘটনায় মামলা করা হবে।
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানায়, হামলাকারীরা জাপান থেকে আনা টিকিট ইস্যুর ভেন্ডিং মেশিন, মনিটরসহ বিভিন্ন নির্দেশক যন্ত্র ভেঙে ফেলেছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা।
কর্তৃপক্ষ বলছে, নষ্ট হওয়া অনেক যন্ত্রপাতি জার্মানের তৈরি। সেখান থেকে আনতে হবে। এজন্য জার্মানে অর্ডার দেওয়ার পর তারা ইউরোপের কোম্পানি দিয়ে তৈরি করাবে। তবে সিগন্যালসহ কিছু সমস্যার সমাধান দেশেই সম্ভব।
জানতে চাইলে ডিএমটিসিএল সচিব আবদুর রউফ কালবেলাকে বলেন, ‘দুর্বৃত্তদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন দুটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কমিটি রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর পরিষ্কার হবে, এই স্টেশনগুলো পুরোপুরি সচল করতে কত সময় লাগবে। তবে আমাদের প্রাথমিক ধারণা, এক বছর লাগতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘মেট্রোর সবকিছুই মূলত টেকনিক্যাল। তাই সুনির্দিষ্ট করে ক্ষতি নির্ণয়ে টেকনিক্যাল পারসনদের কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে। নষ্ট হওয়া অনেক যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আনতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি প্রকৌশলী এনে কাজ করাতে হবে। এজন্য সবকিছু স্বাভাবিক করতে সময় লাগবে।’