দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বেবি স্কেলার (বাচ্চাদের ওজন মাপার যন্ত্র) সরবরাহ করেছিল এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দাম সাড়ে ৭ হাজার টাকা। কিছুদিন ব্যবহারের পর সেটি নষ্ট হয়ে যায়। পরে যন্ত্রটি ঠিক করতে ব্যয় হয় ৪ লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা। অর্থাৎ মেরামতের টাকায় আরও ৫৪টি যন্ত্র কেনা যেত। এখানেই শেষ নয়, রংপুর সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে জেলার সাতটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহে একটি কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যন্ত্রগুলো আনতে হবে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপান থেকে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি এনে হাজির করে মাত্র এক দিনে! তুলে নেয় বিলও।
এমনসব তুঘলকি কাণ্ড যাকে দিয়ে সংঘটিত হয়েছে, তিনি মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ঢাকায় তার পরিচয় স্বাস্থ্যের মাফিয়া বা মিঠু সিন্ডিকেট নামে। মিঠুর মূল প্রতিষ্ঠানের নাম লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ। এর বাইরে তার নামে-বেনামে রয়েছে আরও ৬০টি প্রতিষ্ঠান। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বাজেট তৈরি থেকে শুরু করে কেনাকাটার যাবতীয় পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিতেন। সেই তালিকা ধরে সিএমএসডি, এইচএসএম ও মেডিকেল এডুকেশন দিয়ে যন্ত্রপাতি কেনাতে বাধ্য করতেন। এভাবে ২০ বছরের বেশি সময় মিঠু জিম্মি করে রেখেছেন দেশের স্বাস্থ্য খাত। গত ১৫ বছর মিঠুর বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দেশে বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলছে। বিগত সরকারের অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা, অনেককে গ্রেপ্তার করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলেন স্বাস্থ্যের মাফিয়া হিসেবে পরিচিত এই মিঠু। বিভিন্ন সময়ে তার অপকর্ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও আইনি কোনো জালে তাকে ধরা যায়নি।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ডা. শহীদউল্লাহ ২০২০ সালে করোনায় মারা যাওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়ে মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর বিষয়ে বিস্তারিত জানান। এরপর তদন্ত শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সব প্রতিষ্ঠান নড়েচড়ে বসে। খবর পেয়ে মিঠু বিদেশে পাড়ি জমান। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কের কাছে ব্রংসভিল নামের একটি অভিজাত এলাকায় বাস করেন বলে জানা গেছে। চড়েন রোলস রয়েস গাড়িতে।
মিঠুর আদিবাস রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রাম। যদিও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তার বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ঢাকার গুলশান, বনানী, এলিফ্যান্ট রোড, মালিবাগ, ডিওএইচএস এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের সাতটি বাসার তথ্য আছে। মিঠু দেশ ছাড়লেও তার সহযোগীরা দিব্যি আছেন। মিঠুর দেখানো পথেই তারা এখন চালাচ্ছেন স্বাস্থ্যের কেনাকাটা, আর দূরে বসে সব নিয়ন্ত্রণ করছেন মিঠু। তার নামে আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকেই দেড় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি করার সুপারিশ করলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
দুদকের নথিপত্রে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও আইএইচটি সিলেটসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করার নামে মিঠুর ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে পুকুরচুরি করেছেন মিঠু। যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও এর বিপরীতে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছেন, সেগুলোও ইউরোপ-আমেরিকার নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে ভুয়া স্টিকার লাগানো। কখনোবা নতুন যন্ত্রের বদলে দিয়েছেন রিকন্ডিশন্ড যন্ত্র। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি রোধে দুদক একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। ওই সময় মিঠু দুদক থেকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ প্রাপ্তির পরও দাখিল না করায় তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে দুদক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিঠুর প্রতিষ্ঠান ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কার্যাদেশ পান। কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে মালপত্র সরবরাহ না করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এই টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করেন তিনি। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্রেট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়।
একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত কয়েক বছরে মিঠুর স্ত্রীর ফিউচার ট্রেড ৮৬ কোটি টাকার বেশি কার্যাদেশ পায়। এ থেকে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। ভাগনে মো. ফাহাদ মাহমুদের অরডেন্ট সিস্টেম ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আত্মসাৎ করে ৪ কোটি টাকা। মিঠুর ভাবি সাবিহাতুল জান্নাতের জিএসই অ্যান্ড ট্রেডিং কয়েক বছরে ৩২ কোটি ৬১ লাখ টাকার কার্যাদেশ থেকে আত্মসাৎ করে প্রায় ২০ কোটি টাকা। রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে মোকছেদুলের কিউ সোর্স ২০১৩-১৪ থেকে তিন অর্থবছরে ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চক্রটি সিএমএসডি থেকে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার কার্যাদেশ পায়, তাতে ৪২ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ সময়ে চক্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে আরও ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামীদ বলেন, এত দুর্নীতির অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, দেশের প্রচলিত আইন অনুসারেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মিঠুর আরও কিছু অপকর্ম
মেরামতের ব্যয়: বেবি স্কেলার মতো একটি কার্ডিয়াক মনিটর মেরামতের ব্যয়ও ছিল কেনা দামের চেয়ে বেশি। যন্ত্রটি কেনা হয়েছিল ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকায়। অথচ মেরামতে খরচ দেখানো হয় ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা। একইভাবে ৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকায় ফটোথেরাপি যন্ত্র সরবরাহ করে মেরামত বাবদ নেওয়া হয় ৬ লাখ ৪০০ টাকা।
দেশি যন্ত্রে বিদেশি ট্যাগ: রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের অধীনে সাতটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহে ২০১৬ সালের ২৯ মে কার্যাদেশ পায় কিউ সোর্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যার স্বত্বাধিকারী মিঠুর ভাই মুকুল ইসলাম। পরদিন ৩০ মে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপানের তৈরি ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯০ টাকার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। ১ কোটি ৮ লাখ টাকায় পাঁচটি রেডিয়েন্ট ওয়ার্নার সরবরাহ করা হয় ডেভিড ব্র্যান্ডের, তাতে উৎপাদনকারী দেশের নাম ছিল জার্মানি। কিন্তু ওয়েবসাইটে এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানই খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, মিঠু সিন্ডিকেট এখনো সমানভাবে সক্রিয়। তাদের তৎপরতায় ২৬ কোটি টাকার প্রকল্প ১ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
৬১টি প্রতিষ্ঠান খুলে লুটপাট: একটি সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিঠু ৬১টি আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিন্ডিকেট বানিয়ে সব ধরনের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। মিঠুর নিজ নামে আছে আটটি প্রতিষ্ঠান। সেগুলো হলো লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজার, টেকনো ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি পার্ক লিমিটেড, মেসার্স টেকনো ট্রেড, মেসার্স টেকনো ফিশিং, মেসার্স প্রি-এক্স, সিআর মার্চেন্ডাইজ, লেক্সিকোন হসপিটালাইট, নর্থ এগ লিমিটেড, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রি ফার্ম, অ্যাপল সিরামিক লিমিটেড, মেড ইকুইপ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনভেনচার, টেকনোক্রেট ও এম গেটওয়ে করপোরেশন (যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত)। মিঠুর স্ত্রী নিশাত ফারজানার নামে তিনটি এবং বড় ভাই মো. মোকছেদুল ইসলামের নামে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া মিঠু অন্যান্য ভাই, ভাবি, ভাগনেসহ বন্ধু ও স্বজনদের নামে প্রতিষ্ঠান খুলে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করছেন।
সম্পত্তি ক্রোক ও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা: মিঠুর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুদক। একই সঙ্গে তার স্থাবর ও অস্থাবরসহ মোট ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৮ টাকা মূল্যের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক মশিউর রহমান স্বাক্ষরিত নিষেধাজ্ঞার একটি চিঠি পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠানো হয়। মহানগর সিনিয়র দায়রা জজ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। দুদক বলছে, মিঠু মূলত সিন্ডিকেট করে অতি উচ্চমূল্য দেখিয়ে নিম্নমানের মালপত্র সরবরাহ করতেন।
বিদেশে সম্পদ জব্দ: মিঠুর ঘনিষ্ঠরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে গত ৫ অক্টোবর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে মিঠুর ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এ সম্পদের মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্কের ব্রংকসে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। ২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। ওই দেশে হোটেল-মোটেল ব্যবসারও রয়েছে তার। আটলান্টায় ‘মোটেল সিক্স’ নামে একটি বিলাসবহুল প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক তিনি। যেখানে তার লগ্নি প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলার। নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসেও মিঠুর দুটি দোকান রয়েছে, যেগুলোর মূল্য এক মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ম্যানহাটনে ১৫ মিলিয়ন ডলারে কেনা একটি অফিস রয়েছে মিঠুর। ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় তার আরও দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যা মার্কিন সরকার সম্প্রতি জব্দ করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।